কিন্তু কেবল ধার্মিক ব্যক্তিরাই উমাঈয়াদের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন বোধ করেনি। ধর্মান্ত রের মাধ্যমে ইসলাম গ্রহণকারী (মাওয়ালি: ক্লায়েন্ট) তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মর্যাদায় আপত্তি উত্থাপন করে। আরব মুসলিমদের গোত্রীয় বিভাজনও ছিল, যাদের কেউ কেউ সাধারণ প্রজাদের মাঝে বসতি স্থাপন করে তাদের সঙ্গে মিশে যেতে চেয়েছে, আবার অন্যরা পুরনো সম্প্রসারণবাদী যুদ্ধ অব্যাহত রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। কিন্তু ইসলামী সেন্টিমেন্ট এমন ব্যাপক হয়ে পড়েছিল যে বিভিন্ন বিদ্রোহ আর আন্দোলনের সকল পক্ষই ধর্মীয় কোনও আদর্শ বেছে নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত উমাঈয়াহ্ রাজবংশকে উৎখাতকারী বিদ্রোহের বেলায় এ কথাটি সর্বাংশেই সত্যি। আব্বাসীয় উপদলটি সিংহাসনে মুহাম্মদের(স:) পরিবারের কোনও সদস্যকে দেখার ব্যাপক আকাঙ্ক্ষাকে পুঁজি করে এবং জোর দিয়ে বলে যে তাদের নেতা পয়গম্বরের চাচা আব্বাস এবং তাঁর পুত্র প্রাথমিক কালের কুরান আবৃত্তিকারকদের অন্যতম আবদাল্লাহ্ বংশধর। ৭৪৩-এ তারা ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয় এবং ৭৪৯-এর আগস্টে কুফাহ্ অধিকার করে নেয়, এর পরের বছর ইরাকে শেষ উমাঈয়াহ্ খলিফাহ্ দ্বিতীয় মনসুরকে পরাস্ত করে। অবশেষে যখন তারা সাম্রাজ্য অধিকার করে নেয়, আব্বাসীয় খলিফাগণ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সমাজ গঠন শুরু করেন।
আব্বাসীয় যুগ: খেলাফতের সুবর্ণসময় (৭৫০-৯৩৫)
নিজেদের সযত্নে শিয়া আলোয় তুলে ধরার মাধ্যমে সমর্থন আদায় করেছিল আব্বাসীয়রা, কিন্তু ক্ষমতায় আরোহণের পর তারা এই ধর্মীয় ক্যামোফ্লাজ ঝেড়ে ফেলে এবং পরিষ্কার করে দেয় যে, প্রচলিত কৃষিভিত্তিক চরম রাজতন্ত্র গড়ে তুলতে তারা বদ্ধ পরিকর। প্রথম আব্বাসীয় খলিফাহ্ আবু আল-আব্বাস আল-সাফাহ্ (৭৫০-৫৪) যেখানে উমাঈয়াদের যাকে পেয়েছেন নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন। এর আগে পর্যন্ত কোনও অভিজাত আরব পরিবারের সকল সদস্যেকে নির্বিচারে হত্যা করার ব্যাপারটি ছিল অকল্পনীয়। খলিফাহ্ আবু জাফর আল-মনসুর (৭৫৪-৭৫) তাঁর ক্ষমতার প্রতি হুমকি বিবেচিত সকল শিয়া নেতাকে হত্যা করান। এই খলিফাগণ নিজেদের এমন ধরনের উপাধি দিয়েছিলেন যাতে ক্ষমতাকে স্বর্গপ্রদত্ত অধিকার বোঝায়। আল-মনসুর বোঝায় যে বিজয় অর্জনে ঈশ্বর তাঁকে বিশেষ সাহায্য দেবেন; তাঁর ছেলে আল-মাহদি (পথপ্রাপ্ত) উপাধি নিয়েছিলেন, শিয়ারা এ উপাধিটি প্রয়োগ করে এমন নেতার কথা বোঝানোর জন্য যিনি ন্যায় বিচার আর শান্তির কাল প্রতিষ্ঠা করবেন।
উপাধি নির্বাচন করার সময় খলিফাহ্ আল-মাহদি (৭৭৫-৮৫) হয়ত শিয়াদের তাঁর পিতার সংঘটিত রক্তপাতের ঘটনার পর সন্তুষ্ট করতে চেয়েছিলেন। উমাঈয়াদের পতন ত্বরান্বিতকারী অসন্তোষের ব্যাপারে সচেতন ছিল আব্বাসীয়রা এবং উপলব্ধি করেছিল যে তাদের অবশ্যই বিক্ষুদ্ধ দলগুলোর কাছে কিছু ছাড় দিতে হবে। যদিও তারা নিজেরা আরব ছিল, কিন্তু তাদের বিজয়ের ফলে সাম্রাজ্যে আরবদের বিশেষ সুবিধা লাভের প্রচলিত রেওয়াজের অবসান ঘটে। তারা দামাস্কাস থেকে ইরাকে রাজধানী সরিয়ে নেয়, প্রথমে কুফাহ্ এবং পরে বাগদাদে স্থায়ী হয়। তারা সকল অঞ্চলকে একইভাবে শাসন করার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং কোনও জাতিগত গোষ্ঠীকে বিশেষ মর্যাদা না দেয়ার ঘোষণা দেয় যা মাওয়ালিদের সন্তুষ্ট করেছিল। সাম্রাজ্য এই অর্থে সাম্যবাদী ছিল যে যে-কোনও লোকের পক্ষে রাজদরবার বা আদালতে হাজির হওয়া সম্ভব ছিল তখন। কিন্তু কুফাহ্ থেকে বাগদাদে স্থানান্তর ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। খলিফাগণ পুরনো গ্যারিসন শহরগুলোর আবহ পেছনে ফেলে গেছেন, যেগুলো প্রাচীন গোত্রীয় নকশানুযায়ী নির্মাণ করা হয়েছিল, যেখানে প্রত্যেক অংশ ছিল সমান ও স্বাধীন। বাগদাদের কেন্দ্রস্থল ছিল বিখ্যাত “রাউন্ড সিটি” যেখানে প্রশাসন, রাজদরবার আর রাজপরিবারের অবস্থান ছিল। বাজার আর কর্মী ও দাসদের আবাসস্থলের অবস্থান ছিল সীমানায়। টাইগ্রিসের তীরে ইরাকের কৃষিভিত্তিক সোয়াদের কাছাকাছি এক সুবিধাজনক স্থানে নির্মিত হয়েছিল বাগদাদ, কিন্তু তা পারসিয়ান স্যাসানিয়দের রাজধানী সেটিফনেরও কাছাকাছি ছিল: এবং নতুন খেলাফত প্রাচীন প্রাক-ইসলামী ধারায় গড়ে উঠেছিল।
খলিফাহ্ হারূন আল-রশিদের (৭৮৬-৮০৯) আমল নাগাদ পরিবর্তন চূড়ান্ত হয়ে যায়। আল-রশিদ রাশিদুনদের মত নয়, বরং প্রাচীন কেতার রাজাধিরাজের মত শাসন করেছেন। প্রজাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন তিনি, প্রথম খলিফাঁদের আমলের বৈশিষ্ট্য, অনানুষ্ঠানিকতার স্থান দখল করে নিয়েছিল চোখ টাটান জাঁকজমক। দরবারের সদস্যরা তাঁর সামনে উপস্থিত হবার পর এমন ভঙ্গিতে মাটিতে চুম্বন করতে যা খোদ আরবরা যখন ঈশ্বরের সামনে নত হয়েছিল সেই সময় চিন্তা করাও অসম্ভব ছিল। পয়গম্বরকে যেখানে আর দশজন সাধারণ মানুষের মতই অনানুষ্ঠানিকভাবে তাঁর নাম ধরেই সম্বোধন করা হত খলিফাহ্ সেখানে “পৃথিবীতে ঈশ্বরের ছায়া” উপাধি ধারণ করে বসেন। খলিফার পেছনে জল্লাদ দাঁড়িয়ে থাকত একথা বোঝাতে যে তাঁর প্রাণ দেয়া এবং নেয়ার ক্ষমতা আছে। উম্মাহর খবরদারি আর নিজে করছিলেন না খলিফাহ্ বরং উজিরের হাতে সরকারের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন। তাঁর ভূমিকা দাঁড়িয়েছিল চূড়ান্ত আপীলের দরবার হিসাবে, উপদল বা রাজনীতিকদের নাগালের বাইরে। শুক্রবার অপরাহ্নের প্রার্থনায় নেতৃত্ব দিতেন তিনি আর বড় ধরনের যুদ্ধে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে থাকতেন। অবশ্য সেনাবাহিনীও বদলে গিয়েছিল। এটা আর তখন যেকোনও মুসলিমের জন্যে উন্মুক্ত জনগণের সেনাদল ছিল না, বরং পারসিয়দের একটি বাহিনী হয়ে গিয়েছিল যারা আব্বাসীয়দের ক্ষমতায় আরোহণে সাহায্য করেছিল, খলিফার ব্যক্তিগত বাহিনী হিসাবে বিবেচনা করা হত তাদের।