ইসলামী ইতিহাস রচনাও একই ধরনের আলোচনাচক্র হতে আবির্ভূত। চলমান সমস্যাদির সমাধান বের করতে গিয়ে মুসলিমরা উপলদ্ধি করে যে তাদের পয়গম্বর এবং বাঁশিদুনের আমলের শরণ নিতে হচ্ছে। খলিফা কী কুরাইশ গোত্রের সদস্য হওয়া উচিত নাকি কোনও আনসারের বংশধর গ্রহণযোগ্য? মুহাম্মদ(সঃ) কি এ বিষয়ে কোনও বক্তব্য রেখে গেছেন? উত্তরাধিকার সম্পর্কে কী ব্যবস্থা করেছিলেন মুহাম্মদ(সঃ)? উসমানের হত্যাকাণ্ডের পর আসলে কী ঘটেছিল? মুহাম্মদ ইবন ইসহাকের মত ঐতিহাসিকগণ (মৃত্যু: ৭৬৭) ওইসমস্ত আহাদিস সংগ্রহ শুরু করলেন যেগুলো কুরানের কোনও কোনও অনুচ্ছেদকে পয়গম্বর যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ প্রত্যাদেশ লাভ করেছেন তার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে। ইবন ইসহাক পয়গম্বর মুহাম্মদের(স:) এক বিস্তারিত জীবনী (সিরাহ্) রচনা করেন যা আনসারদের গুণাবলীর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং মুহাম্মদের(সঃ) বিরোধিতাকারী মক্কাবাসীদের দুষ্কর্ম তুলে ধরেছে। তিনি স্পষ্টতই শিয়াদের দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষ নিয়েছেন যে মুসলিমদের আবু সুফিয়ানদের বংশধরদের দ্বারা শাসিত হওয়া উচিত নয়। এইভাবে ইতিহাস এক ধর্মীয় কাজে পরিণত হয় যা পরস্পরের বিরুদ্ধে নীতিভিত্তিক বিরোধিতাকে যৌক্তিকতা দান করে।
সুতরাং উম্মাহ্ রাজনৈতিক সুস্থতা উদীয়মান ইসলামী ধার্মিকতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। খলিফাহ্ ও তাঁর প্রশাসন যেখানে যেকোনও কৃষিভিত্তিক সাম্রাজ্যের ওপর নেমে আসা নানা সমস্যা মোকাবিলায় এবং একটি শক্তিশালী রাজশক্তি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ছিলেন, সেখানে ধার্মিক ব্যক্তিরা এধরনের যেকোনও সমাধানের চরম বিরোধিতা করেছে। সুতরাং একেবারে গোড়া থেকেই কোনও শাসকের আচরণ এবং নীতিমালা এক ধর্মীয় তাৎপর্য পেয়ে এসেছে যার সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের ভাববাদ, অতীন্দ্রিয়বাদ, পবিত্র জুরিসপ্রুডেন্স এবং প্রাথমিক থিয়োলজিক্যাল চিন্তার ভাবনা গভীর বিপরীত সম্পর্ক ছিল।
উমাঈয়াহদের শেষ বছরগুলো (৭০৫-৭৫0)
অধিকতর ধার্মিক ব্যক্তিদের অসম্মতি সত্ত্বেও আব্দ আল-মালিক তাঁর ছেলে প্রথম আল-ওয়ালিদের উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন: ইসলামী বিশ্বে প্রথম বারের মত বংশধারার নীতি বিনা আপত্তিতে গৃহীত হয়। উমাঈয়াহ্ বংশ এর সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল। আল-ওয়ালিদের অধীনে মুসলিম সেনাবাহিনী উত্তর আফ্রিকা অধিকার করে এবং স্পেনে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এটাই ইসলামের পশ্চিম অভিমুখী বিস্তারের সীমা চিহ্নিত করে দেয়। ৭৩২-এ চার্লস মারটেল যখন পয়টিয়ার্সে মুসলিম বাহিনীকে পরাজিত করেন, মুসলিমরা একে বড় কোনও বিপর্যয় বলে ভাবেনি। পশ্চিমের লোকজন প্রায়ই পয়টিয়ার্সের গুরুত্বে অতিরঞ্জন আরোপ করে, যা মোটেই ওয়াটারলু ছিল না। আরবরা ইসলামের নামে পশ্চিমে ক্রিশ্চান জগৎ অধিকার করার ধর্মীয় বা অন্য কোনওরকম তাগিদ বোধ করেনি। প্রকৃতপক্ষে ইউরোপ লক্ষ্যণীয়ভাবে অনাকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছে: পশ্চাদপদ ওই অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ খুব একটা ছিল না, লুণ্ঠিত মালের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হত না, পরিবেশ ছিল জঘন্য।
দ্বিতীয় উমর (৭১৭-২০)-এর শাসনামলের শেষ দিকে ঝামেলায় পড়ে সাম্রাজ্য। প্রাক-আধুনিক যে কোনও সাম্রাজ্যেরই আয়ুষ্কাল ছিল সীমিত, যেহেতু এর ভিত্তি ছিল কৃষিজাত উদ্বৃত্ত, এমন একটা পর্যায় অনিবার্য যখন এক বিশাল সম্প্রসারণশীল রাষ্ট্র এর সম্পদ শেষ করে ফেলবে। কনসট্যান্টিনোপল দখল করার এক বিপর্যয়কর প্রয়াসের মাসুল গুনতে হয়েছিল উমরকে, যা কেবল ব্যর্থই হয়নি বরং প্রচুর লোকবল আর সাজসরঞ্জামের ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। উমরই প্রথম খলিফাহ্ যিনি জিম্মিদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণে অনুপ্রাণিত করেন, তারাও গতিশীল নতুন ধর্মবিশ্বাসকে আলিঙ্গন করতে উদগ্রীব ছিল; কিন্তু যেহেতু তাদের আর টোল ট্যাক্স (জিযিয়াহ্) দেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকত না, সে কারণে নতুন নীতি রাজস্ব আয়ের পরিমাণ বিপুলভাবে কমিয়ে দিয়েছিল। ধার্মিক মানুষ ছিলেন উমর, যিনি মদীনায় বড় হয়েছেন এবং সেখানকার ধর্মীয় আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। নিজের আচরণকে তিনি রাশিদুনদের আদলে গড়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছিলেন, ইসলামী ঐক্যের ওপর জোর দিয়েছেন, সকল অঞ্চলকে সমতার ভিত্তিতে বিবেচনা করেছেন (সিরিয়ার প্রতি পক্ষপাত না দেখিয়ে) আর জিম্মিদের প্রতি মানবিক আচরণ করেছেন। অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন তিনি; কিন্তু তাঁর ইসলামী নীতিমালা, যা তাঁকে ধার্মিকদের কাছে আপন করে তুলেছিল, সাম্রাজ্যের রুগ্ন অর্থনীতির জন্য সঠিক ছিল না। তাঁর উত্তরসূরীদের শাসনামলগুলো বিদ্রোহ আর তীব্র অসন্তোষে আকীর্ণ ছিল। খলিফারা দ্বিতীয় ইয়াযিদের (৭২০-২৪) মত অসচ্চরিত্রের হোক কিংবা হিশামের (৭২৪-৪৩) মত ধার্মিকই হোন, তাতে আর কিছু এসে যায়নি। হিশাম শক্তিশালী এবং কার্যকর খলিফাহ্ ছিলেন, সাম্রাজ্যকে অধিকতর শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি, কিন্তু সেটা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল রাষ্ট্রকে কঠোরভাবে কেন্দ্রীকরণ এবং আপন শাসনকে আরও স্বৈরাচারী করার ফলে। তিনি অধিকহারে প্রচলিত একচ্ছত্র রাজাধিপতিতে পরিণত হচ্ছিলেন, এতে রাজনৈতিক দিক দিয়ে সাম্রাজ্য লাভবান হয়েছিল। কিন্তু সমস্যা হল, এধরনের স্বৈরাচারী ব্যবস্থা আবার ধার্মিকদের চোখে ঘৃণিত এবং মৌলিকভাবে অনৈসলামিক। তবে কি নীতির ভিত্তিতে কোনও রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব নয়? শিয়ারা ক্রমবর্ধমান হারে সক্রিয় হয়ে উঠছিল। তাদের নেতারা আলীর বংশধর হিসাবে দাবী করেন নিজেদের, তাঁদের বিশ্বাস ছিল, যে ইল্ম মুসলিমদের ন্যায়-বিচারভিত্তিক সমাজ গঠনে সক্ষম করে তুলতে পারে তা কেবল মুহাম্মদের(স:) পরিবারের মাঝেই সম্পূর্ণভাবে রক্ষিত আছে এবং কেবল তাদেরই শাসন করার অধিকার আছে। অধিকতর চরমপন্থী শিয়ারা উম্মাহর বর্তমান সব সমস্যার জন্য প্রথম তিন রাশিদুনকে (আবু বকর, উমর এবং উসমান) দায়ী করে, যাঁদের উচিত ছিল প্রথমেই আলীর হাতে নেতৃত্ব তুলে দেয়া। আরও চরমপন্থী শিয়াদের (ঘুলাত: অতিরঞ্জনকারী হিসাবে পরিচিত) বেশীর ভাগ ছিল ধর্মান্তরিত মুসলিম এবং তারা তাদের পুরনো কিছু বিশ্বাসও বজায় রেখেছিল। আলীকে তারা ঈশ্বরের এক অবতার (জেসাসের মত) হিসাবে দেখেছে, তাদের বিশ্বাস ছিল বিদ্রোহে নিহত শিয়া নেতৃবৃন্দ এক অস্থায়ী “গোপন স্থানে” (“occultation”) অবস্থান করছেন এবং তাঁরা শেষ জমানায় ন্যায়-বিচার ও শান্তির এক স্বপ্নরাজ্যের উদ্বোধন করার জন্য ফিরে আসবেন।