এই নয়া মুসলিম ধার্মিকতার প্রটোটাইপ এবং শ্রেষ্ঠ আদর্শ পুরুষ ছিলেন হাসান আল-বাসরি (মৃত্যু ৭২৮), যিনি পয়গম্বরের পারিবারিক বলয়ে বেড়ে উঠেছিলেন এবং উসমানের মৃত্যুর পরও বেঁচে ছিলেন। পরবর্তী সময়ে বসরায় চলে যান তিনি যেখানে পার্থিব জিনিসের প্রতি বৈরাগ্যের ওপর ভিত্তি করে পয়গম্বরের সহজ-সরল জীবনধারার অনুরূপ এক আধ্যাত্মিকতা গড়ে তোলেন। কিন্তু বসরার সবচেয়ে খ্যাত ধর্মপ্রচারকে পরিণত হন হাসান, তাঁর সাধারণ জীবন-যাপন রাজদরবারের বিলাসীতার বাঙ্ময় এবং প্রচ্ছন্ন বিরোধিতাপূর্ণ সমালোচনার রূপ নেয়। বসরা এক ধর্মীয় সংস্কারের কাজ শুরু করেন হাসান, অনুসারীদের গভীরভাবে কুরান নিয়ে ধ্যান করার তাগিদ দেন এবং এই শিক্ষা দেন যে গভীর চিন্তা, আত্মপর্যালোচনা এবং ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণই প্রকৃত সুখের উৎস, কেননা এগুলো মানবীয় আকাঙ্ক্ষা এবং মানুষের জন্যে ঈশ্বরের ইচ্ছার মাঝে বিরাজিত টানাপোড়েন দূর করে। হাসান উমাঈয়াদের সমর্থন করেছিলেন বটে, কিন্তু এটা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে প্রয়োজনে তাঁদের সমালোচনা করার অধিকার তিনি রাখেন। তিনি কাদেরিয়াহ্ নামে পরিচিত থিয়োলজির পক্ষ বেছে নেন, কারণ তা ঈশ্বরের বিধানসমূহ (কাদার) নিয়ে কাজ করে। মানবজাতির স্বাধীন ইচ্ছা রয়েছে এবং মানুষ তার কর্মকাণ্ডের জন্যে দায়ী; কোনও সুনির্দিষ্ট কাজ করার ব্যাপারে বাধ্য নয় তারা, ঈশ্বর যেহেতু ন্যায় বিচারক সেহেতু মানুষের সাধ্যের মধ্যে না থাকলে তিনি তাদের সৎপথে জীবনযাপনের নির্দেশ দিতেন না। সুতরাং খলিফাঁদের অবশ্যই তাঁদের কাজের জবাবদিহি করতে হবে এবং যদি তাঁরা ঈশ্বরের সুস্পষ্ট শিক্ষা অমান্য করেন তাহলে অবশ্যই প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে। খলিফাহ্ আব্দ আল-মালিক যখন হাসানের এরকম প্রচ্ছন্ন বিদ্রোহমূলক মতবাদ প্রচারের সংবাদ পেলেন, রাজদরবারে তলব করলেন তাঁকে, কিন্তু হাসানের তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে তাঁকে শান্তি দেয়ার সাহস পাননি তিনি। হাসান সুশৃঙ্খল আত্মিকজীবনের সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক বিরোধিতার মিশেল ঘটিয়ে এক শক্তিশালী মুসলিম ধারার সূচনা করেছিলেন।
কাদেরিয়ারা উমাঈয়াহ্ শাসন মেনে নিয়েছিল, কারণ একেই উম্মাহর ঐক্য রক্ষায় সক্ষম বলে মনে হয়েছিল; সুতরাং খারেজিদের বিরোধিতা করেছে তারা যাদের বিশ্বাস ছিল উমাঈয়ারা ধর্মত্যাগী এবং মৃত্যুদণ্ড লাভের যোগ্য। হাসানের শিষ্য ওয়াসান ইবন আতা (মৃত্যু: ৭৪৮) এক মধ্যপন্থী মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এ দুটো চরম অবস্থান থেকে “প্রত্যাহারের” (ইতাযাহু) মাধ্যমে। মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতার প্রতি জোর দেয়া, রাজদরবারের বিলাসীতার নিন্দা জানানো এবং মুসলিমদের সাম্যতার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপের দিক থেকে মুতাযিলারা কাদেরিয়াদের সঙ্গে একমত হয়েছিল। কিন্তু ঈশ্বরের ন্যায় বিচারের প্রতি জোর দেয়ার ফলে মুতাযিলারা যেসব মুসলিম অন্যদের প্রতি শোষণমূলক আচরণ করে তাদের প্রতি চরম সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তারা আলী এবং মুয়াবিয়ার ব্যাপারে রায় দেয়া থেকে বিরত থাকে, কারণ তাদের দাবী ছিল একমাত্র ঈশ্বরই জানেন মানুষের মনে কী আছে। এর সঙ্গে খারেজিদের চরমপন্থার পার্থক্য স্পষ্ট, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রায়ই মুতাযিলাদের রাজনৈতিক কর্মী হতে দেখা গেছে। কুরান মুসলিমদের “সৎকাজে নির্দেশ আর অসৎ কাজ থেকে দূরে থাকার আদেশ”[১] দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে এবং কোনও কোনও খারেজির মতই মুতাযিলারা এ বাণীকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল। কেউ কেউ শিয়া বিদ্রোহে সমর্থন দেয়, আর হাসান আল-বাসরির মত অন্যরা যেসব শাসক কুরানের আদর্শ অনুযায়ী চলেনি তাদের নিন্দা জানিয়েছেন। শতাব্দী কাল সময়ের মধ্যে মুতাযিলারা ইরাকের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। একটা যুক্তি ভিত্তিক থিয়োলজি (কালাম) গড়ে তুলেছিল মুতাযিলারা যেখানে ঈশ্বরের কঠোর একত্ব আর সরলতার ওপর জোর দেয়া হয়েছে, উম্মাহর সংহতির মধ্য দিয়ে যা প্রতিফলিত হওয়ার কথা।
আরেকটি মতবাদ, মুরজিয়াও আলী ও মুয়াবিয়াহ্ ক্ষেত্রে রায় প্রদানে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, কারণ মানুষের মনের অবস্থাই আসল। মুসলিমদের অবশ্যই কুরান অনুযায়ী রায় ঘোষণা “স্থগিত” (আর্জা) রাখতে হবে। সুতরাং, উমাঈয়াদের তারা এমন কিছু করে বসার আগেই অবৈধ শাসক বলে বিচার বা নাকচ করে দেয়া ঠিক হবে না, বরং যদি তারা ঐশীগ্রন্থের মানদণ্ড লঙ্ঘন করে তাহলে তাদের তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করা যেতে পারে। এই মতবাদের সবচেয়ে বিখ্যাত অনুসারী ছিলেন কুফার একজন বণিক আবু হানিফাহ্ (৬৯৯-৭৬৭)। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং জুরিসপ্রুডেন্সের (ফিকহ্) এক নতুন ধারার নেতৃত্ব দেন যা ইসলামী ধার্মিকতায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে এবং মুসলিম বিশ্বের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মূল শাস্ত্রে পরিণত হয়। ফিকহ্’র মূলেও রয়েছে গৃহযুদ্ধ পরবর্তী ব্যাপক অসন্তোষ। লোকেরা পরস্পরের বাড়ি বা মসজিদে মিলিত হয়ে উমাঈয়াহ্ সরকারের অযোগ্যতা নিয়ে আলোচনা করত। ইসলামী নীতিমালা অনুসারে কীভাবে সমাজ পরিচালনা করা যায়? জুরিস্টরা এমন সুনির্দিষ্ট এক আইনী বিধিমালা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যা ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে সম্পূর্ণ নিখুঁতভাবে আত্মসমর্পণকারী একটা সমাজ গঠনে কুরানে প্রদত্ত নির্দেশ পবিত্র স্বপ্নের বদলে বাস্তব সম্ভাবনায় পরিণত করবে। এই প্রাথমিক জুরিস্টগণ (ফাকিহ্) বসরাহ্, কুফাহ্, মদীনা এবং দামাসকাসে যাঁর যাঁর নির্দিষ্ট সমাজের জন্য আইনগত পদ্ধতি বের করেন। সমস্যা ছিল তাঁদের, কুরানে খুব কমই আইন রয়েছে এবং যেসব আইন আছে তাও তৈরি হয়েছে অনেক সরল- সমাজের জন্য। তো জুরিস্টদের কেউ কেউ পয়গম্বর এবং তাঁর সহচরবৃন্দ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কেমন আচরণ করেছিলেন তার “সংবাদ” বা “প্রতিবেদন” (আল- হাদিস, একবচনে: হাদিস) সংগ্রহ শুরু করেন। অন্যরা সূচনা স্বরূপ তাঁদের শহরে মুসলিমদের প্রথাগত অনুশীলন (সুন্নাহ্)কে বেছে নেন এবং সেটাকে গোড়ার দিকে সহচরদের- যাঁরা ওখানে বসতি করেছিলেন- তাঁদের কারও সঙ্গে সম্পর্কিত করার প্রয়াস পান। তাঁদের বিশ্বাস ছিল এভাবে তাঁরা প্রকৃত ইল্ম, কোনটা সঠিক এবং কেমন করে চলতে হবে সে জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন। আবু হানিফাহ্ উমাঈয়াহ্ আমলের শ্রেষ্ঠ আইনবিদে পরিণত হয়েছিলেন এবং তিনি জুরিসপ্রুডেন্সের একটি মতবাদ (মাযহাব) প্রতিষ্ঠা করেন মুসলিমরা যা আজও অনুসরণ করে। তিনি নিজে খুব বেশী লেখালেখি করেননি, কিন্তু তাঁর অনুসারীরা উত্তর প্রজন্মের জন্যে তাঁর শিক্ষা লিপিবদ্ধ করে গেছে; অন্যদিকে পরবর্তী সময়ের জুরিস্টগণ সামান্য পৃথক তত্ত্ব আবিষ্কার করে নতুন মাযহাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।