আব্দ আল-মালিক (৬৮৫-৭০৫) আবার উমাঈয়াহ্ শাসন ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর শাসনামলের শেষ বার বছর ছিল শান্তি আর সমৃদ্ধির কাল। তিনিও নিরঙ্কুশ ক্ষমতাবান রাজা ছিলেন না, কিন্তু দ্বিতীয় ফিৎনাহ্’র পর স্পষ্টতই সেদিকে ধাবিত হচ্ছিলেন। স্থানীয় আরব গোত্র প্রধানদের বিরুদ্ধে উম্মাহর সংহতি বজায় রাখেন তিনি, বিদ্রোহীদের সামাল দেন আর কেন্দ্রীকরণের সুসংহত নীতি অনুসরণ করেন। সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে আরবী পারসির স্থান অধিকার করে; প্রথম বারের মত ইসলামী মুদ্রা চালু হয় যাতে কুরানের বাণী উৎকীর্ণ ছিল। জেরুজালেমে ৬৯১-তে ডোম অভ দ্য রক- প্রথম প্রধান ইসলামী মন্যুমেন্ট- এর নির্মাণকাজ শেষ হয়- যা গর্বের সঙ্গে পবিত্র নগরীটিতে ইসলামের প্রাধান্য ঘোষণা করেছে- বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্রিশ্চানদের বাস ছিল এখানে। ‘ডোম’ ইসলামের অনন্যসাধারণ স্থাপত্য ও শিল্পকলার রীতির ভিত্তিও স্থাপন করেছিল: কোনওরকম শারীরিক অবয়ব থাকতে পারবে না, যা উপাসনাকারীদের দুর্ভেয় সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে–মানুষের কল্পনায় সঠিকভাবে যার প্রকাশ করা যায় না। এর বদলে ডোমের অভ্যন্তর সাজানো হয় ঈশ্বরের বাণী কুরানের পঙক্তি দিয়ে। মুসলিম স্থাপত্যকলার প্রধান বৈশিষ্ট্যে পরিণত হওয়া খোদ ডোমটি বিশ্বাসীদের আকাঙ্ক্ষিত স্বর্গে আরোহণের আধ্যাত্মিক প্রতীক, অবশ্য তাওহীদের নিখুঁত ভারসাম্যও প্রকাশ করে তা। এর বাইরের অংশ, যা অসীম আকাশের দিকে উঠে গেছে, অভ্যন্তরীণ মাত্রারই নিখুঁত অনুকৃতি। এটা দেখায় কীভাবে মানুষ এবং ঈশ্বর, অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক জগৎ, একটি পূর্ণাঙ্গ জিনিসের দুটি অংশ হিসাবে পরস্পরকে পূর্ণতা দেয়। মুসলিমরা আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছিল এবং তারা তাদের নিজস্ব অনন্য আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরছিল।
এই পরিবর্তিত পরিবেশে যে কঠোর নিয়মের কারণে মুসলিমরা প্রজা সাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল ধীরে ধীরে তা শিথিল হয়ে আসে। অমুসলিমরা গ্যারিসন শহরগুলোয় বসতি শুরু করে; কৃষিজীবীরা মুসলিম এলাকায় কাজ পায় এবং আরবীতে কথা বলা শেখে। বণিকগণ মুসলিমদের সঙ্গে বাণিজ্য শুরু করে, এবং যদিও ধর্মান্তরকরণের বিষয়ে উৎসাহ দেয়া হচ্ছিল না, কোনও কোনও রাজকীয় কর্মকর্তা ইসলাম গ্রহণ করে। কিন্তু পুরনো বিভেদ ভেঙে পড়ায় সাধারণ মানুষ আরব মুসলিমদের বাড়তি সুবিধার ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করে। খারেজি এবং শিয়াদের দমন এক তিক্ত অনুভূতি সৃষ্টি করে রেখেছিল। আব্দ আল-মালিক আরব এবং গ্যারিসন শহরগুলোয় এক নতুন আন্দোলন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন, যারা ইসলামী আদর্শের আরও কঠোর প্রয়োগের ব্যাপারে চাপ দিচ্ছিল। আব্দ আল-মালিক এসব নতুন ধারণায় আগ্রহী থাকলেও দাবী করেন যে কুরান তাঁর নীতির সমর্থন করে। এসব নব্য ধর্মানুরাগীদের কেউ কেউ অবশ্য কুরানের আরও সক্রিয় ভূমিকা চেয়েছিল এবং সমর্থক বা শিখণ্ডি হিসাবে ব্যবহৃত না হয়ে কুরান নেতৃত্ব দেবে এটাই চেয়েছে তারা।
ধর্মীয় আন্দোলন
গৃহযুদ্ধগুলো বহু জটিল প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। যে সমাজ-এর নিবেদিত নেতাদের (ইমাম) হত্যা করেছে সেটি ঈশ্বর পরিচালিত বলে দাবী করে কীভাবে? কোন ধরনের লোকের উম্মাহর নেতৃত্ব দেয়া উচিত? খলিফাঁকে কী সবচেয়ে ধার্মিক মুসলিম (খারেজিরা যেমন বিশ্বাস করে), পয়গম্বরের সরাসরি বংশধর (শিয়ারা যেমন মনে করে) হতে হবে নাকি বিশ্বাসীদের উচিত শান্তি আর ঐক্যের খাতিরে সকল ব্যর্থতা ত্রুটি সত্ত্বেও উমাঈয়াদেরই মেনে নেয়া? প্রথম ফিৎনার সময় কে সঠিক ছিলেন, আলী না মুয়াবিয়াহ্? আর উমাঈয়াহ্ রাষ্ট্র কতখানি ইসলামী? যেসব শাসক এমন বিলাসী জীবনযাপন করে আর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দারিদ্র্য মেনে নেয় তারা কি প্রকৃত মুসলিম হতে পারে? আর যেসব আরব ইসলাম গ্রহণ করে কোনও না কোনও আরব গোত্রের “ক্লায়েন্টে” (মাউয়ালি) পরিণত হয়েছে তাদের অবস্থানটা কী? এতে করে কি একথাই বোঝায় না যে, এখানে এমন এক শভিনিজম আর বৈষম্য রয়েছে যা কুরানের সঙ্গে সম্পূর্ণই বেমানান?
এইসব রাজনৈতিক আলোচনার ভেতর দিয়েই আমাদের পরিচিত ইসলামের ধর্ম ও ধার্মিকতার বিষয়টি বেরিয়ে আসতে শুরু করে। কুরান আবৃত্তিকার এবং অন্য চিন্ত–াশীল ব্যক্তিরা প্রশ্ন উত্থাপন করে যে মুসলিম হওয়ার প্রকৃত অর্থ কী? তারা তাদের সমাজকে প্রথমত ইসলামী এবং তারপর আরব হিসাবে দেখতে চেয়েছে। কুরান সমগ্র মানব জীবনের একীভূতকরণের (তাওহীদ) কথা বলে, যার মানে ব্যক্তিবিশেষ এবং রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মকাণ্ডে ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রতি নতি স্বীকার করার কথা প্রকাশ পাওয়া উচিত। বিকাশের একই রকম পর্যায়ে ক্রিশ্চানরা জেসাসের প্রকৃতি ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে বারবার তপ্ত-বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল, যা তাদের ঈশ্বর, মোক্ষ লাভ এবং মানবীয় অবস্থা সম্পর্কে নিজস্ব আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। গৃহযুদ্ধগুলোর পরবর্তী কালের উম্মাহ্ রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্পর্কে প্রবল বিতর্ক ইসলামে চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে খ্রিষ্টধর্মের ক্ষেত্রে ক্রিস্টোলজিক্যাল বিতর্কের অনুরূপ ভূমিকা পালন করেছে।