এর মাঝেই ছিল এক দ্বিধার অবস্থান। কয়েক শতাব্দীর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে জানা গিয়েছিল যে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রাক-আধুনিক কোনও সাম্রাজ্য শাসনের একমাত্র কার্যকর পদ্ধতি হল পরম রাজতন্ত্র; এবং তা সামরিক অলিগারকির (military oligarchy) চেয়ে অনেক বেশী সন্তোষজনক– যেখানে সেনাপ্রধানরা সাধারণত ক্ষমতার জন্য পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে। আমাদের গণতান্ত্রিক যুগে একজন ব্যক্তিকে এমন সুবিধাপ্রাপ্ত করে তোলা, যেখানে ধনী-দরিদ্র সমানভাবে তার সামনে নাজুক অবস্থানে পড়ে, তা আমাদের চোখে ঘৃণিত, কিন্তু আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে শিল্প-উন্নত সমাজের কারণেই গণতন্ত্র সম্ভবপর হয়ে উঠেছে, যে সমাজের এর সম্পদসমূহ অনির্দিষ্ট মাত্রায় বাড়িয়ে তোলার প্রযুক্তি রয়েছে। পাশ্চাত্যের আধুনিকতার আবির্ভাবের আগে যা সম্ভব ছিল না। প্রাক-আধুনিক বিশ্বে শক্তিশালী একজন রাজার, যার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, সশরীরে যুদ্ধে অংশ নেয়ার প্রয়োজন হত না, অভিজাতদের বিবাদ মীমাংসা করতে পারতেন এবং দরিদ্রদের পক্ষে বক্তব্য দানকারীদের আবেদন অগ্রাহ্য করার কোনও কারণ থাকত না তাঁর। রাজার বেলায় এই সুবিধাটি এত জোরাল ছিল যে, আমরা দেখব, এমনকি যখন বৃহৎ সাম্রাজ্যের স্থানীয় প্রকৃত ক্ষমতা স্থানীয় শাসকরা নিয়ন্ত্রণ করছে তখনও তারা রাজার গুণ গাইছে এবং নিজেদের তাঁর সেবক বলে দাবী করছে। উমাঈয়াহ্ খলিফাগণ এক সুবিশাল সাম্রাজ্য শাসন করেছেন, যা তাঁদের শাসনকালে অব্যাহতভাবে বিস্তার লাভ করে। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, শান্তি বজায় রাখার স্বার্থে তাঁদের একচ্ছত্র রাজা হওয়াই প্রয়োজন, কিন্তু কীভাবে তা একদিকে আরব ঐতিহ্য আর অন্যদিকে কুরানের চরম সাম্যবাদী নীতির সঙ্গে খাপ খাবে?
প্রথম দিকের উমাঈয়াহ্ খলিফাগণ একচ্ছত্র রাজা ছিলেন না। মুয়াবিয়াহ্ একজন আরব গোত্রপতির মতই শাসন করেছেন, প্রাইমাস ইন্টার পেয়ারেস-এর মত। আরবরা চিরকাল রাজতন্ত্রকে অবিশ্বাস করে এসেছে, অসংখ্য ছোট ছোট গ্রুপ যেখানে অপ্রতুল সম্পদের অংশ পেতে প্রতিযোগিতা করে, সেখানে তা সম্ভবও নয়। বংশ পরম্পরা শাসনের কোনও ব্যবস্থা তাদের ছিল না, কেননা গ্রোত্র প্রধান হিসাবে সবসময় গোত্রের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিটিকে পেতে চাইত তারা। কিন্তু ফিৎনাহ্ই বুঝিয়ে দিয়েছিল বিতর্কিত বিচ্ছেদের বিপদ। উমাঈয়াদের “সেক্যুলার” শাসক মনে করাটা ভুল হবে। মুয়াবিয়াহ্ ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন, নিবেদিতপ্রাণ মুসলিম-ইসলামের চলমান ধারণা অনুসারে। মুসলিমদের প্রথম কিবলাহ্ এবং অতীতের বহু মহান পয়গম্বরের আবাসভূমি জেরুজালেমের পবিত্রতার প্রতি নিবেদিত ছিলেন তিনি। উম্মাহর ঐক্য বজায় রাখার জন্যে কঠোর পরিশ্রম করেছেন তিনি। তাঁর শাসনের ভিত্তি ছিল কুরানের তাগিদ যে সকল মুসলিম পরস্পরের ভাই, তারা অবশ্যই পরস্পরের সঙ্গে সংঘাত থেকে বিরত থাকবে। কুরানের শিক্ষা অনুযায়ী তিনি জিম্মিদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত অধিকার দিয়েছিলেন। কিন্তু ফিৎনার অভিজ্ঞতা খারেজিদের মত কোনও কোনও মুসলিমের মনে দৃঢ় ধারণার জন্ম দিয়েছিল যে রাষ্ট্রিয় ও ব্যক্তি পর্যায়ে ইসলামের অর্থ আরও ব্যাপক হওয়া উচিত।
সুতরাং কৃষিভিত্তিক রাষ্ট্রের চাহিদা এবং ইসলামের মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন সংঘাত ছিল এবং মুয়াবিয়ার পরলোকগমনের পর তা দুঃখজনক ভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তিনি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন যে উত্তরাধিকারী, নিশ্চিত করার জন্যে তাঁকে অবশ্যই আরব ঐতিহ্য থেকে সরে আসতে হবে এবং পরলোকগমনের আগেই পুত্র প্রথম ইয়াযিদের (৬৮০-৮৬) ক্ষমতারোহনের ব্যবস্থা গিয়েছিলেন। কিন্তু এর পরপরই প্রবল গোলমাল শুরু হয়ে যায়। কুফা আলীর অনুগতরা আলীর দ্বিতীয় পুত্র হুসেইনের শাসন দাবী করে বসে। অল্পক’জন অনুসারী এবং তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে মদীনার উদ্দেশে অগ্রসর হন হুসেইন। এদিকে স্থানীয় উমাঈয়াহ্ গভর্নর কুফাবাসীদের ভীতি প্রদর্শন করায় তারা সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। আতসমর্পণে অস্বীকৃতি জানান হুসেইন, তাঁর অবশ্য জোর বিশ্বাস ছিল প্রকৃত ইসলামী মূল্যবোধের সন্ধানে স্বয়ং পয়গম্বরের পরিবারের অভিযাত্রা উম্মাহকে তার মূল দায়িত্বের কথাটি স্মরণ করিয়ে দেবে। কুফার অনতিদূরে, কারবালা প্রান্তরে সসৈন্য উমাইয়াদের বাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান তিনি। সদ্যজাত শিশুকে কোলে নিয়ে সবার শেষে প্রাণ দেন হুসেইন। সকল মুসলিমই পয়গম্বরের দৌহিত্রের করুণ মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে, কিন্তু নিজেদের যারা শিয়া-ই-আলী বলে মনে করে পয়গম্বরের বংশধরদের ক্ষেত্রে হুসেইনের পরিণতি অনেক গভীরভাবে তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে থাকে। আলীর হত্যাকাণ্ডের মত কারবালার করুণ ঘটনাটিও শিয়া মুসলিমদের চোখে মানবজাতিকে ঘিরে রাখা অবিরাম অবিচারের প্রতাঁকে পরিণত হয়েছে; এটা যেন রাজনীতির কঠিন জগতের সঙ্গে ধর্মীয় আদেশ বাস্তবায়নের অসম্ভাব্যতাও দেখিয়ে দেয়, যার সঙ্গে রয়েছে এর প্রবল বিরোধ।
হিজাযে আবদাল্লাহ ইবন আল-যুবায়েরের নেতৃত্বে সংঘটিত অভ্যুত্থানটি ছিল আরও বেশী ভয়াবহ। যুবায়ের ছিলেন উটের যুদ্ধে আলীর বিরুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এক বিদ্রোহীর সন্তান। এটা উমাঈয়াদের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে তা আবার মক্কা ও মদীনায় পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে প্রথম উম্মাহ্ উন্নত মূল্যবোধে ফিরে যাবার প্রয়াসও ছিল। ৬৮৩তে উমাঈয়াহ্ বাহিনী মদীনা দখল করে নেয়, কিন্তু সেবছর প্রথম ইয়াযিদ এবং তার শিশু পুত্র দ্বিতীয় মুয়াবিয়াহ্ অকাল মৃত্যু পরবর্তী ধোয়াঁটে পরিস্থিতিতে মক্কা নগরী হতে অবরোধ তুলে নেয়। আরও একবার গৃহযুদ্ধের কারণে বিভক্ত হয়ে পড়ে উম্মাহ্। ইবন আল-যুবায়ের খলিফাহ্ হিসাবে ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করেন, কিন্তু ৬৮৪তে খারেজি বিদ্রোহীরা মধ্য আরবে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বসলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তিনি; ইরাক এবং ইরানেও খারেজি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়; হুসেইনের হত্যাকাণ্ডের বদলা নেয়ার জন্য কুফার শিয়ারা ক্ষেপে ওঠে, তারা আলীর অপর পুত্রকে প্রার্থী হিসাবে দাঁড় করাতে চায়। বিদ্রোহীদের সকলেই কুরানের সাম্যবাদী নীতির পক্ষে কথা বলেছে, কিন্তু সফলকাম হয়েছিল সিরিয়ানরা- প্রথম মুয়াবিয়া এক উমাঈয়াহ্ কাজিন মারওয়ান এবং তার পুত্র আব্দ আল-মালিকের নামে। ৬৯১ নাগাদ তারা সকল বিদ্রোহীকে দমন করে এবং এর পরের বছর স্বয়ং ইবন আল-যুবায়েরকে পরাস্ত ও হত্যা করে।