কিন্তু তার মানে ঐতিহ্যের পাইকারী প্রত্যাখ্যান ছিল না। অ্যাক্সিয়াল যুগের পয়গম্বর এবং সংস্কারকগণ তাদের অঞ্চলের প্রাচীন পৌত্তলিক আচারের উপর নির্ভর করেছেন এবং মুহাম্মদ(স:)ও তাই করবেন। অবশ্য তিনি মানাত, আল-লাত এবং আল-উযযাহ্’র মত জনপ্রিয় আরবীয় দেবীদের কাল্ট উপেক্ষা করার দাবী জানিয়েছেন, কেবল আল্লাহ্র উপাসনার কথা বলেছেন। প্যাগান দেবতাদের কুরানে দুর্বল গোত্র প্রধানদের মত বলে উল্লেখ করা হয়েছে যারা তাদের জাতির জন্য দায় বিশেষ, কারণ তারা তাদের পর্যাপ্ত প্রতিরক্ষা দিতে অক্ষম। কুরান একেশ্বরবাদের পক্ষে কোনও দার্শনিক যুক্তি তুলে ধরেনি; এর আহবান বাস্তববাদী এবং সেকারণে বাস্তববাদী আরবদের কাছে আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছে। কুরান দাবী করেছে, প্রাচীন ধর্ম আর কাজ কারছে না।[৩] আধ্যাত্মিক অস্থিরতা, পৌনঃপুনিক ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ-বিগ্রহ আর অবিচার আরব ঐতিহ্য আর গোত্রীয় মূল্যবোধের লঙ্ঘন করে চলছে। মাত্র একজন ঈশ্বর এবং ন্যায় বিচার ও সাম্যতার ভিত্তিতে পরিচালিত ঐকবদ্ধ উম্মাহর মাঝেই সমাধান নিহিত।
একেবারে নতুন শোনালেও, কুরান জোর দিয়ে বলেছে এর বাণী সর্বজনবিদিত সত্যের “স্মারক” মাত্র।[৪] এটাই আদি ধর্মবিশ্বাস যা অতীতের পয়গম্বরগণ গোটা মানবজাতির কাছে প্রচার করে গেছেন। মানব জাতির যেভাবে চলা উচিত ঈশ্বর সে সম্পর্কে তাকে অজ্ঞ রাখেন নাঃ পৃথিবীর সকল জাতির নিকট তিনি বার্তাবাহক প্রেরণ করেছেন। ইসলামী বিবরণসমূহ পরবর্তীকালে এধরনের ১,২৪,০০০ পয়গম্বর আগমন করেছিলেন বলে উল্লেখ করে, অসীমতা বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত এটি একটি প্রতীকী সংখ্যা। প্রত্যেকেই তাদের জাতির জন্য ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণাজাত গ্রন্থ পৌঁছে দিয়েছেন; সেগুলো ঈশ্বরের ধর্মের সত্যকে ভিন্নভাবে প্রকাশ করে থাকতে পারে, কিন্তু অত্যাবশ্যকীয়ভাবে মূলবাণী বরাবর একই ছিল। অবশেষে এবার ঈশ্বর কুরাইশদের কাছে একজন পয়গম্বর এবং একটি ঐশীগ্রন্থ প্রেরণ করেছেন। কুরান বারবার উল্লেখ করেছে যে, মুহাম্মদ (স:) পুরনো ধর্মসমূহকে রদ করার জন্য আসেননি, তাদের পয়গম্বরদের বিরোধিতা করতে বা নতুন ধর্ম প্রবর্তন করতে ও নয়। তাঁর বাণী আব্রাহাম, মোজেস, ডেভিড, সলোমন কিংবা জেসাসের বাণীর অনুরূপ।[৫] কুরান কেবল আরবদের পরিচিত পয়গম্বরদের নামই উল্লেখ করেছে, কিন্তু বর্তমানে মুসলিম পণ্ডিতগণ যুক্তি দেখান যে মুহাম্মদ(স:) যদি বৌদ্ধ বা হিন্দু, অস্ট্রেলীয় আদিবাসী বা আদি আমেরিকানদের কথা জানতেন, কুরান তাদের সাধুদেরও স্বীকার করত, কারণ সঠিক পথে পরিচালিত সকল ধর্মবিশ্বাস যা পরিপূর্ণভাবে ঈশ্বরের কাছে সমর্পিত, যা মানবসৃষ্ট দেবতাকে উপাসনা করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং ন্যায়বিচার ও সাম্যের কথা বলে তা একই স্বর্গীয় উৎস থেকে আগত। এই কারণে মুহাম্মদ(স:) ইহুদি বা ক্রিশ্চানদের তারা নির্দিষ্টভাবে ইচ্ছা প্রকাশ না করলে ইসলাম গ্রহণের আহবান জানাননি; কেননা তারা পূর্ণাঙ্গ বৈধ নিজস্ব প্রত্যাদেশ লাভ করেছিল। কুরান জোরের সঙ্গে বলেছে যে, “ধর্মের ব্যাপারে কোনও জোরজবরদস্তি নেই,”[৬] এবং মুসলিমদের ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে নির্দেশ দিয়েছে, কুরান যাদের আহল্ আল-কিতাব বলে আখ্যা দিয়েছে। সাধারণভাবে “ঐশী গ্রন্থধারী জাতি” হিসাবে এই শব্দবন্ধটি অনুদিত হয়ে থাকে, কিন্তু অধিকতর সঠিকভাবে যা “পূর্বের প্রত্যাদেশেপ্রাপ্ত জাতি” বোঝায়:
তোমরা কিতাবীদের সঙ্গে তর্কবিতর্ক করবে, কিন্তু সৌজন্যের সাথে, তবে যারা ওদের মধ্যে সীমালঙ্ঘন করবে তাদের সাথে নয়। আর বলো, “আমাদের ওপর ও তোমাদের ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে আমরা বিশ্বাস করি। আর আমাদের উপাস্য ও তোমাদের উপাস্য তো একই, আর তাঁরই কাছে আমরা আত্মসমর্পণ করি।”[৭]
কেবল আমাদের অধিকতর আধুনিক সংস্কৃতির পক্ষেই মৌলিকত্বের কদর এবং ঐতিহ্যকে পাইকারিভাবে পরিত্যাগ পরিত্যাগ করা সম্ভব। প্রাক-আধুনিক সমাজে ধারাবাহিকতা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মুহাম্মদ(স:) অতীতের সঙ্গে প্রবল বিচ্ছেদ বা অন্য বিশ্বাসের সমাজের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার কথা চিন্তা করেননি। নতুন ঐশীগ্রন্থকে তিনি আরবের আধ্যাত্মিক দৃশ্যপটে স্থাপন করতে চেয়েছেন।
একারণেই মুসলিমরা মক্কার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত চৌকো-আকৃতির উপাসনাগৃহ কাবা প্রথাগত আচার অব্যাহত রেখেছিল, যা আরবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাসনা কেন্দ্র ছিল। এমনকি মুহাম্মদের(স:) সময়কালেও একেবারে প্রাচীন ছিল উপাসনা গৃহটি, এর সঙ্গে সম্পর্কিত কাল্টের মূল তাৎপর্য হারিয়ে গিয়েছিল বিস্মৃতির আড়ালে, কিন্তু প্রতিবছর সমগ্র পেনিনসূলা থেকে হজ্জ তীর্থযাত্রা উপলক্ষ্যে আগত আরবদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিল এটি। তারা পৃথিবীর চারদিকে সূর্যের গতিপথ অনুসরণ করে উপাসনাগৃহকে ঘিরে সাতবার প্রদক্ষিণ করত; কাবার দেয়ালে গাঁথা কৃষ্ণ-পাথর চুম্বন করত, যা সম্ভবত: পৃথিবীর বুকে এসে পড়া উল্কাপিণ্ড ছিল, স্বর্গীয় জগতের সঙ্গে উপাসনাগৃহের অবস্থানের সংযোগ স্থাপন করেছিল। এসব আচার (উমরাহ্ নামে পরিচিত) যে কোনও সময় পালন করা যেত; কিন্তু হজ্জ তীর্থযাত্রার সময়েও তীর্থযাত্রীরা কাবাহর পার্শ্ববর্তী আল-সাফা পাহাড় থেকে উপত্যকার উপর দিয়ে আল-মারওয়াহ্ অবধি দৌড়াত, সেখানে গিয়ে প্রার্থনা করত তারা। এরপর তারা মক্কার উপকণ্ঠে এসে আরাফাতের ময়দানে সারারাত জাগ্রত অবস্থায় পাহারায় থাকত, সদলবলে তারা মুয্দালিফাহ্ উপত্যকায় ছুটে গিয়ে মিনার একটা পাথরকে লক্ষ্য করে নুড়ি পাথর নিক্ষেপ করত, মাথা মুণ্ডন করত এবং তীর্থযাত্রার শেষ দিন ঈদ-আল-আযহায় পশু উৎসর্গ করত।