ধর্মীয় জীবনের মৌলিক প্যারাডক্স সম্ভবত এই যে, এটা আমাদের জাগতিক জীবনের অতীত অস্তিত্বের এক মহা দুর্জ্জেয়ের সন্ধান করে, কিন্তু মানব জীবন এই দুর্ভেয় সত্তাকে কেবল পার্থিব বাস্তব ঘটনার মাঝেই অনুভব করতে সক্ষম। মানুষ পাথর, পাহাড়, মন্দির-ভবন, বিধি-বিধান, লিখিত বিবরণ কিংবা ভিন্ন নারী আর পুরুষের মাঝে ঐশ্বরিক অনুভূতি লাভ করেছে। আমরা কখনওই প্রত্যক্ষভাবে দুর্ভেয়ের অভিজ্ঞতা অর্জন করিনিঃ আমাদের পরম আনন্দ সবসময়ই “জাগতিক,” মর্ত্যেরই কোনও ব্যক্তিতে বা কোনও বস্তুতে আসীন। ধর্মীয় ব্যক্তিগণের পবিত্রকে দেখার জন্য সম্ভাবনাহীন ক্ষেত্রে অনুসন্ধানে লিপ্ত হবার যোগ্যতা থাকে। তাঁদের নিজস্ব সৃজনশীল কল্পনাশক্তির প্রয়োগ ঘটানোর প্রয়োজন পড়ে। জাঁ পল সার্ত্রে কল্পনাশক্তিকে অস্তিত্ব নেই এমন কিছুর চিন্তা করার ক্ষমতা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। মানবজাতি ধর্মীয় প্রাণী, কারণ তারা কল্পনানির্ভর; তাদের গঠন এমন যে তারা অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আর একধরনের আনন্দ অনুসন্ধানে বাধ্য হয় যা কিনা তাদের মাঝে পরিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকার অনুভূতি জাগায়। প্রত্যেক ঐতিহ্য বিশ্বাসীদের পার্থিব এমন কোনও প্রতাঁকের প্রতি মনোযোগ স্থাপন করার উৎসাহ জোগায় যা কেবল বিশেষভাবে এর নিজস্ব, এবং যা তাদের ঐ প্রতাঁকের মাঝেই ঈশ্বরকে দেখার শিক্ষা দেয়।
ইসলাম ধর্মে মুসলিমরা ইতিহাসে ঈশ্বরের সন্ধান করেছে। তাদের পবিত্র ঐশীগ্রন্থ, কুরান, তাদের এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব দিয়েছে। তাদের প্রধান দায়িত্ব ছিল একটা ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজ সৃষ্টি করা যেখানে এর সকল সদস্য, এমনকি সবচেয়ে দুর্বল এবং নাজুকজনটিও, সর্বাধিক সম্মানের অধিকারী হবে। এমন এক সমাজ নির্মাণের অভিজ্ঞতা এবং সেই সমাজে বসবাস তাদের ঈশ্বরের অনুভূতি যোগাবে, কারণ সেক্ষেত্রে তারা ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী জীবনযাপন করবে। একজন মুসলিমকে ইতিহাসের দায় মুক্তি ঘটাতে হয় এর অর্থ রাষ্ট্রীয় কার্যাবলী আধ্যাত্মিকতা হতে বিচ্যুত তো নয়ই বরং খোদ ধর্মেরই বিষয়। মুসলিম সমাজের রাজনৈতিক কল্যাণের অপরীসীম গুরুত্ব ছিল। যেকোনও ধর্মীয় আদর্শের মত ইতিহাসের নানা বিচ্যুতি আর করুণ প্রেক্ষাপটে এর বাস্তবায়ন ছিল প্রায় দুরূহ, কিন্তু প্রতিটি ব্যর্থতার পরেই মুসলিমদের আবার উঠে দাঁড়িয়ে নতুন প্রয়াসে লিপ্ত হতে হয়েছে।
মুসলিমরা অন্যদের মত করেই তাদের নিজস্ব আচার, অতীন্দ্রিয়বাদ, দর্শন, মতবাদ (Doctrine), পবিত্র লিপি, আইন আর উপাসনালয় গড়ে তুলেছে। কিন্তু এসব ধর্মীয় প্রয়াসের সবগুলোরই উদ্ভব ঘটেছে ইসলামী সমাজের চলমান রাজনৈতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে প্রায়শ: যন্ত্রণাময় চিন্তাভাবনা হতে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ যদি কুরানের আদর্শ মোতাবেক পরিচালিত না হয়, যদি তাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নিষ্ঠুর কিংবা শোষক হন, কিংবা যদি তাদের সমাজ আপাত: ধর্মহীন শত্রু দ্বারা অপদস্থ হয়, একজন মুসলিম ভাবতে পারে যে জীবনের পরম লক্ষ্য এবং মূল্যে তার বিশ্বাস বিপদাপন্ন হয়ে পড়েছে। ইসলামী ইতিহাসকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্যে সর্বাত্মক প্রয়াস নিতে হবে তাকে, তা নাহলে গোটা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানই ব্যর্থ হয়ে যাবে, জীবন হারিয়ে ফেলবে তার অর্থ। সুতরাং রাজনীতি, ক্রিশ্চানরা যেমন বলে, সেক্রামেন্ট, এটা এমন এক ক্ষেত্র যেখানে মুসলিমরা ঈশ্বরকে উপলব্ধি করে যা পার্থিব জগতে ঈশ্বরকে কার্যকরভাবে ক্রিয়াশীল হতে সক্ষম করে তোলে। পরিণামে, মুসলিম সমাজের ঐতিহাসিক প্রয়াস আর দুঃখ-দুর্দশা- রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা, গৃহবিবাদ, আগ্রাসন এবং শাসক গোষ্ঠীর উত্থান ও পতন– অভ্যন্তরীণ ধর্মীয় অনুসন্ধান হতে বিচ্ছিন্ন কোনও বিষয় নয়, বরং ইসলামী দর্শনের মূল উপাদান (essence)। একজন মুসলিম তার আপন সময়কালের চলতি ঘটনাপ্রবাহ এবং অতীত ইতিহাস নিয়ে চিন্তা করবে, যেমন করে একজন ক্রিশ্চান কোনও আইকন নিয়ে ভাববে, স্বর্গীয় গোপন সত্তাকে আবিষ্কার করার জন্যে সৃজনশীল কল্পনা ব্যবহার করার মাধ্যমে। সুতরাং মুসলিম জনগণের বাহ্যিক ইতিহাসের বিবরণ স্রেফ গৌণ আগ্রহের বিষয় হতে পারে না, কেননা ইসলামের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ইতিহাসের পবিত্রায়ন।
ঘটনাক্রমপঞ্জী
৬১০ মক্কায় পয়গম্বর মুহাম্মদ(স:) কুরানের প্রথম প্রত্যাদেশ লাভ করেন এবং এর দু’বছর পর ধর্ম প্রচার শুরু করেন।
৬১৬ মক্কার শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে মুহাম্মদের(স:) নবদীক্ষিতদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে; নিপীড়ন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে এবং মুহাম্মদের(স:) মক্কায় অবস্থান ক্রমবর্ধমান হারে অসম্ভব হয়ে ওঠে।
৬২০ ইয়াসরিবের (পরবর্তীকালে মদীনা নামে পরিচিত) বসতি হতে আগত আরবগণ মুহাম্মদের(স:) সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে তাঁকে তাদের সমাজে নেতৃত্ব দানের আমন্ত্রণ জানায়।
৬২২ আনুমানিক সত্তরটি মুসলিম পরিবারসহ পয়গম্বর মক্কা হতে মদীনায় হিজরা বা অভিবাসন করেন এবং মক্কার শাসক গোষ্ঠী প্রতিশোধ নেয়ার শপথ গ্রহণ করে। হিজরার মাধ্যমে মুসলিম বছর গণনার সূচনা ঘটে।
৬২৪ বদরের যুদ্ধে মুসলিমরা মক্কার উপর এক নাটকীয় পরাজয় চাপিয়ে দেয়।