জিহাদ ছিল বিস্ময়করভাবে সফল। সাফাভীয়দের বিরুদ্ধে প্রথম সেলিমের (১৪৬৭-১৫২০) অভিযান যা ইরানি অগ্রযাত্রাকে থমকে দিয়েছিল –এক বিজয়মণ্ডিত যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হয় যার ফলে সমগ্র সিরিয়া এবং মিশর অটোমান শাসনের আওতায় চলে আসে। আরব এবং উত্তর আফ্রিকা সাম্রাজ্যের অঙ্গীভূত হয়ে গিয়েছিল। পশ্চিমে, অটোমান সেনাবাহিনী ইউরোপ অধিকার অব্যাহত রাখে এবং ১৫৩০-এ পৌঁছে যায় ভিয়েনার দোরগোড়ায়। সুলতানগণ অসাধারণ আমলাতান্ত্রিক দক্ষতার সঙ্গে এমন এক সুবিশাল সাম্রাজ্য শাসন করেছেন, এ সময়ের আর কোনও রাষ্ট্র এর ধারে-কাছে ঘেঁষতে পারেনি। সুলতান তাঁর প্রজাদের ওপর একরূপতা চাপিয়ে দেননি বা সাম্রাজ্যের অসদৃশ উপাদানসমূহকে একটা বিরাট দলে টানতে চাননি। সরকার কেবল এমন একটা কাঠামোর ব্যবস্থা করেছে যা বিভিন্ন গ্রুপকে–ক্রিশ্চান, ইহুদি, আরব, তুর্কী, বারবার বণিক, উলেমা, তরিকাহ্ আর ব্যবসায়ী গোষ্ঠী– শান্তিময় পরিবেশে বসবাস সক্ষম করে তুলেছিল, প্রত্যেকে যার যার অবদান রেখেছে, নিজ নিজ বিশ্বাস আর রীতি পালন করেছে। এভাবে সাম্রাজ্যে ছিল বিছিন্ন গোষ্ঠীর এক মিশেল, যার প্রতিটি এর সদস্যদের প্রত্যক্ষ বিশ্বস্ততা দাবী করত। একজন গভর্নর (পাশা) কর্তৃক শাসিত, দুটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল সাম্রাজ্য, যিনি সরাসরি ইস্তাম্বুলের কাছে জবাবদিহি করতেন।
সুলেইমান আল-কানুনির (“দ্য ল-গিভার”) (১৫২০-৬৬) শাসনামলে সাম্রাজ্য সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে। পাশ্চাত্যে ইনি সুলেইমান দ্য ম্যাগনিফিশেন্ট নামে খ্যাত। তাঁর শাসনাধীনে সাম্রাজ্য এর সম্প্রসারণের সর্বশেষ সীমায় পৌঁছে যায়। ইস্তাম্বুল এক সাংস্কৃতিক রেনেসাঁ প্রত্যক্ষ করেছিল, যার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল অনন্যসাধারণ স্থাপত্য কর্ম, বিশেষ করে দরবারী স্থাপতি সিনান পাশার (মৃত্যু: ১৫৭৮) স্থাপত্য কর্ম। গোটা সাম্রাজ্য জুড়ে নির্মিত অটোমান মসজিদগুলোর সুস্পষ্ট ভিন্ন স্টাইল ছিল: ওগুলো ছিল খোলামেলা, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা ছিল সেখানে, নিচু গম্বুজ আর সুউচ্চ মিনার ছিল ওগুলোর। চিত্রকলা, ইতিহাস আর চিকিৎসাবিজ্ঞানকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে বেশ উঁচু পর্যায়ে পৌঁছে দেয় দরবার; ১৫৭৯-তে একটা মানমন্দির নির্মিত হয়; আর নৌপথ ও ভৌগলিক ক্ষেত্রে নতুন ইউরোপীয় আবিষ্কারে আলোড়িত হয়েছে। সম্প্রসারণের এই বছরগুলোয় পাশ্চাত্যের সঙ্গে তথ্যের আন্তরিক আদান- প্রদান ঘটে, তখন ইউরোপের বিভিন্ন সাফল্য সত্ত্বেও অটোমান সাম্রাজ্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরাশক্তি ছিল।
অন্য দু’টি সাম্রাজ্যের মত অটোমানরাও তাদের রাজ্যকে একটা বিশেষ ইসলামী পরিচয় দিয়েছিল। সুলেইমানের অধীনে অতীতের যেকোনও মুসলিম রাষ্ট্রের তুলনায় শরিয়াহ্ অনেক বেশী মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিল। সকল মুসলিমের জন্যে সরকারি আইনে পরিণত হয় তা। অটোমানরাই প্রথম শরিয়াহ্ আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞগণ– কাজিগণ, যারা আদালতে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতেন; তাদের পরামর্শক (মুফতি), যারা আইনের ব্যাখ্যা দিতেন; এবং মাদ্রাসার শিক্ষকগণ –সরকারি বাহিনীতে পরিণত হন। সুলতানের সঙ্গে প্রজা সাধারণের নৈতিক ও ধর্মীয় যোগসূত্র গড়ে তোলেন এঁরা। আরব প্রদেশগুলোয় এটা সবিশেষ মূল্যবান ছিল, যেখানে রাষ্ট্র ও উলেমাদের মধ্যকার অংশীদারি জনগণকে তুর্কি শাসন মেনে নিতে সাহায্য করেছিল। উলেমাদের কেবল পবিত্র আইনের সমর্থনই ছিল না–যা শাসকদের বৈধতা দিয়েছিল বরং প্রায়শ এমনটি ঘটতে দেখা গেছে যে, নির্দিষ্ট প্রদেশের স্থানীয় অধিবাসী উলেমাগণ, স্বদেশী জনতা এবং তুর্কি গভর্নরের মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছেন।
অটোমানদের প্রজাসাধারণ প্রধানত শরিয়াভিত্তিক রাজ্যের সদস্য হিসাবে গর্বিত ছিল। কুরান শিক্ষা দিয়েছে যে ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী বসবাসকারী উম্মাহ্ সমৃদ্ধি লাভ করবে, কেননা তা অস্তিত্বের মৌলনীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রাথমিক অটোমানদের বিস্ময়কর সাফল্য, যাদের বৈধতা ব্যাপকভাবে ঈশ্বর প্রত্যাদিষ্ট আইনের প্রতি আনুগত্যের ওপর দাঁড়িয়েছিল, এই বিশ্বাসের পক্ষেই সাক্ষ্য দেয় বলে প্রতীয়মান হয়েছে। উলেমাগণও এটাও অনুভব করেছিলেন যে এই সাম্রাজ্য তাঁদেরই রাজ্য আর অটোমানগণ রাষ্ট্রীয় নীতি এবং মুসলিম বিবেকের এক বিরল সমন্বয় অর্জন করেছে। কিন্তু এই অংশীদারির আবার- ফলপ্রসূ ছিল বটে– নেতিবাচক দিকও ছিল, কেননা এটা উলেমাদের ক্ষমতায়নের পরিবর্তে শেষ অবধি তাদের কণ্ঠরোধ, এমনকি অপমানিত করেছে। শরিয়ার সূচনা হয়েছিল প্রতিবাদ আন্দোলন হিসাবে এবং এর গতিশীলতার অধিকাংশের মূলে ছিল বিরোধী অবস্থান। অটোমান ব্যবস্থার অধীনে অনিবার্যভাবে তা হারিয়ে গিয়েছিল। উলেমাগণ রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। সরকারী কর্মকর্তা হিসাবে, সুলতান এবং তাঁর পাশাগণ ভর্তুকি প্রত্যাহারের হুমকি দিয়ে- করেছেনও- তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। আবু আল-সুন্দ খোলা চেলেবি (১৪৯০-১৫৭৪), যিনি অটোমান-উলেমা মৈত্রীর নীতিমালা প্রণয়ন করেছিলেন, স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে কাজিগণ শরিয়া অভিভাবক সুলতানের তরফ থেকে কর্তৃত্ব লাভ করে থাকেন সুতরাং তাঁরা তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী আইন প্রয়োগে বাধ্য। এভাবে শরিয়াহ্কে চরম রাজতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়াতে বাধ্য করা হয় (যা আগের চেয়ে ঢের বেশী শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল) –মূলত যার বিরোধিতা করার উদ্দেশ্যেই সূচনা ঘটেছিল এর।