নতুন গোত্রটি শেষ পর্যন্ত ইসলাম (আত্মসমর্পণ) নামে অভিহিত হয়; একজন মুসলিম সেই নারী বা পুরুষ যে তার সমগ্র সত্তা আল্লাহ্ এবং তাঁর ইচ্ছা যে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত সাম্য আর সহানুভুতির সঙ্গে ব্যবহার করবে, তার প্রতি সমর্পণ করেছে। এটা একটি ভঙ্গি বা আচরিক প্রার্থনার (সালাত) ভঙ্গিতে প্রকাশ পায়, মুসলিমদের প্রতিদিন তিনবার যা পালন করতে হত। (পরবর্তীকালে এই প্রার্থনা দিনে পাঁচ বারে বৃদ্ধি পায়)। প্রাচীন গোত্রীয় নীতি বা মূল্যবোধ ছিল সমতাভিত্তিক; আরবরা রাজতন্ত্রের ধারণা সমর্থন করত না এবং ক্রীতদাসের মত মাটিতে মাথা ঠোকার ব্যাপারটি তাদের কাছে ঘৃণিত ছিল। কিন্তু প্রার্থনার ভঙ্গি নির্ধারণ করা হয়েছিল মক্কায় দ্রুত বেড়ে ওঠা কঠিন ঔদ্ধত্য আর স্বয়ংসম্পূর্ণতার অনুভূতির পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে। মুসলিমদের দেহের ভঙ্গিমা তাদের পুন:শিক্ষা দান করবে, তাদের অহঙ্কার আর স্বার্থপরতা ভুলে যাবার শিক্ষা দেবে এবং স্মরণ করিয়ে দেবে যে ঈশ্বরের সামনে তারা কিছুই নয়। কুরানের কঠোর শিক্ষা পালন করার জন্যে মুসলিমদের তাদের আয়ের একটি নির্ধারিত অংশ দান (যাকাত) হিসাবে দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করতে হত। দরিদ্রদের বঞ্চনার কথা উপলব্ধি করার জন্য, যারা পছন্দ মত খেতে বা পান করতে পারে না। রমযান মাসে উপবাসও পালন করতে হত।
সুতরাং সামাজিক ন্যায়বিচারই ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। মুসলিমদের প্রধান কর্তব্য হিসাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে: এমন একটি সমাজ (উম্মাহ্) গড়ে তুলতে হবে বাস্তব সহমর্মিতাই যার প্রধান বৈশিষ্ট্য, যেখানে সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন রয়েছে। ঈশ্বর সম্পর্কে যেকোনও মতবাদ ভিত্তিক শিক্ষার চেয়ে এটা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃত প্রস্তাবে ধর্মতাত্ত্বিক আঁচ-অনুমান সম্পর্কে কুরানের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, যাকে যান্নাহ্ বলে অভিহিত করা হয়েছে, যার অর্থ, কারও পক্ষেই ধারণা করা অসম্ভব এমন অলৌকিক বিষয়ে স্বকপোলকল্পিত ধারণা প্রদান। এধরনের বিমূর্ত ডগমা নিয়ে তর্ক করা অর্থহীন বলে মনে করা হয়; বরং ঈশ্বর মানুষের জন্য যেমন জীবন-ধারা নির্ধারণ করে দিয়েছেন সেভাবে জীবনধারণ করার প্রয়াস (জিহাদ) চালানো অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। উম্মাহর রাজনৈতিক ও সামাজিক কল্যাণ মুসলিমদের জন্য পবিত্র মূল্যবহ। যদি উম্মাহ্ সমৃদ্ধি লাভ করে তাহলে সেটা মুসলিমরা যে ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী জীবনযাপন করছে তারই লক্ষণ; এবং একটি প্রকৃত ইসলামী সমাজে বসবাসের অভিজ্ঞতা, যা ঈশ্বরের কাছে সর্বাঙ্গীনভাবে আত্মসমর্পণ করেছে, মুসলিমদের পবিত্র দুর্ভেয়ের অনুভূতি যোগাবে। পরিণামে তারা উম্মাহ্ যেকোনও দুভার্গ্য বা অপমানে প্রবলভাবে তাড়িত হবে যেমন ক্রিশ্চানরা কাউকে অপমানকরভাবে বাইবেল মাড়িয়ে যেতে দেখলে কিংবা শেষ ভোজের ছবি ছিঁড়তে দেখলে তাড়িত হয়।
এই সামাজিক উদ্বেগ বরাবরই মহান বিশ্ব ধর্মসমূহের আবশ্যকীয় অংশ ছিল যা ঐতিহাসিকরা যাকে অ্যাক্সিয়াল যুগ (Axial Age c.৭০০ বিসিই থেকে ২০০ বিসিই) বলেছেন সেই সময় বিকাশ লাভ করেছিল, যখন আমাদের পরিচিত সভ্যতা কনফেশনাল ধর্মবিশ্বাস সমূহের পাশাপাশি গড়ে উঠছিল, মানবজাতিকে যা অব্যাহতভাবে উন্নত করে তুলেছে: চীনের তাওবাদ এবং কনফুসিয়ানিজম; ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু ধর্মমত ও বুদ্ধধর্ম; মধ্যপ্রাচ্যে একেশ্বরবাদ; এবং ইউরোপে যুক্তিবাদ। এইসব বিশ্বাস প্রাচীন পৌত্তলিকতাবাদের সংস্কার সাধন করেছে, যা কিনা অধিকতর বৃহৎ এবং আরও জটিল সমাজে এই সাংস্কৃতিক প্রয়াসকে সমর্থন জোগাতে সক্ষম বাণিজ্য ভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার পর আর পর্যাপ্ত বলে মনে হচ্ছিল না। বৃহত্তর রাজ্যসমূহের মানুষ আরও প্রশস্ত দিগন্তের সন্ধান লাভ করেছিল এবং স্থানীয় কাল্টসমূহ যথার্থতা হারাচ্ছিল; ক্রমবর্ধমানহারে অ্যাক্সিয়াল যুগের ধর্মবিশ্বাসগুলো একক উপাস্য বা দুর্জেয়ের সর্বোচ্চ প্রতাঁকের দিকে মনোযোগী হয়ে উঠেছিল। প্রত্যেকটি বিশ্বাসই যার যার সমাজে বিরাজিত মৌল অবিচার সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিল। প্রাক-আধুনিক সকল সভ্যতাই অর্থনেতিকভাবে উদ্বৃত্ত কৃষিপণ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল; সুতরাং কৃষকদের শ্রমের ওপর নির্ভর করতে হত তাদের যারা আবার তাদের উন্নত সংস্কৃতির অংশীদার হতে পারত না, যা ছিল কেবল অভিজাতদের জন্যে। এর মোকাবিলা করার জন্য নতুন ধর্মবিশ্বাসসমূহ সহমর্মিতার গুরুত্বের ওপর জোর দেয়। আরব সভ্য জগতের বাইরে রয়ে গিয়েছিল। এর অবাধ্য জলবায়ুর অর্থ ছিল, আরবরা অনাহারের উপান্তে বসবাস করছে; তাদের এমন কোনও উপায় আছে বলে মনে হয়নি যে তাদের পক্ষে কৃষি ভিত্তিক উদ্বৃত্ত অর্জন করে স্যাসানিয় পারসিয়া বা বাইযানটিয়ামের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়ানো সম্ভব হবে। কিন্তু কুরাইশরা বাজার অর্থনীতি গড়ে তোলার পর তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যেতে শুরু করেছিল। অনেকেই তখনও প্রাচীন পৌত্তলিকতাবাদ নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল, কিন্তু মাত্র একজন ঈশ্বরের উপাসনা করার ক্রমবর্ধমান একটা প্রবণতারও বর্ধিষ্ণু অস্বস্তি ও ছিল। আরবরা এখন তাদের নিজস্ব অ্যাক্সিয়াল-যুগ ধর্ম বিশ্বাসের জন্য প্রস্তুত।