তিনি এক ক্রান্তিকালীন চরিত্র হিসাবে প্রমাণিত হয়েছেন। শতাব্দীর শেষ দিকে এসে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে মোঘল সাম্রাজ্যের পতন সূচিত হয়েছে। সেনাবাহিনী এবং দরবার দুটোই অতিমাত্রায় ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছিল; সম্রাটগণ তখনও সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছিলেন, কিন্তু কৃষির প্রতি প্রয়োজনীয় নজর দেননি, যার ওপর তাঁদের সম্পদ নির্ভরশীল ছিল। আউরেঙজিবের শাসনামলে (১৬৫৮-১৭০৭) অর্থনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করে। তাঁর বিশ্বাস ছিল মুসলিম সমাজের বৃহত্তর শৃঙ্খলার মাঝে সমাধান নিহিত। মুসলিম “ভিন্ন মতাবলম্বী”দের পাশাপাশি অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতিও ভয়ঙ্কর ঘৃণাবোধের মাঝে তাঁর নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি প্রকাশিত হয়েছে। সিরহিন্দির মত মুসলিম, যাঁরা পুরনো ধর্মীয় বহুত্ববাদে অসন্তুষ্ট ছিলেন তাঁদের কাছ থেকে সাম্প্রদায়িক নীতির পক্ষে সমর্থন পান তিনি। ভারতে হুসেইনের সম্মানে শিয়াদের উৎসব উদযাপন নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, আইন করে সুরাপান নিষিদ্ধ করা হয় (যা হিন্দুদের সঙ্গে মেলামেশা কঠিন করে তোলে) এবং হিন্দু অনুষ্ঠানাদিতে সম্রাটের অংশগ্রহণের হার মারাত্মকভাবে হ্রাস করা হয়। জিযিয়াহ্ পুনর্বহাল করা হয় এবং হিন্দু বণিকদের ওপর দ্বিগুণ হয়ে যায় করের হার। সবচেয়ে মারাত্মক, সমগ্র সাম্রাজ্য জুড়ে হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস করা হয়। প্রতিক্রিয়া দেখায় যে পূর্ববর্তী সহিষ্ণুতা কত প্রাজ্ঞ ছিল হিন্দুগোত্রপ্রধান আর শিখদের নেতৃত্বে মারাত্মক বিদ্রোহ পরিচালিত হয়, শিখরা পাঞ্জাবে নিজস্ব স্বদেশের জন্যে আন্দোলন শুরু করে।
করে। আউরেঙজিবের পরলোকগমনের পর টালমাতাল অবস্থায় পড়ে সাম্রাজ্য এবং আর কখনও সামলে উঠতে পারেনি। উত্তরাধিকারীগণ তাঁর সাম্প্রদায়িক নীতি পরিহার করেন, কিন্তু ক্ষতি যা হবার আগেই হয়ে গিয়েছিল। এমনকি মুসলিমরা পর্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েছিল, শরিয়াহ্র প্রতি আউরেঙজিবের উৎসাহে প্রকৃতপক্ষে ইসলামী কিছু ছিল না; শরিয়াহ্ সবার জন্যে ন্যায়বিচারের কথা বলে-জিম্মিরা সহ। সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে শুরু করেছিল এবং স্থানীয় মুসলিম কর্মকর্তারা স্বায়ত্তশাসিত একক হিসাবে যার যার এলাকা নিয়ন্ত্রণ শুরু করে।
অবশ্য ১৭৩৯ পর্যন্ত মোঘলরা ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছিলেন এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজদরবারে হিন্দু ও মুসলিমদের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, পরস্পরের ভাষায় কথা বলতে শেখে তারা এবং ইউরোপ থেকে আসা বইপত্র একসঙ্গে পাঠ ও অনুবাদ করে। কিন্তু শিখ ও পার্বত্য অঞ্চলের হিন্দু গোত্রপতিরা শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখে এবং উত্তর-পশ্চিমে ইরানের সাফাভীয় সাম্রাজ্যের পতন ডেকে আনা আফগান গোত্রগুলো ভারতে একটা মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ব্যর্থ প্রয়াস পায়। ভারতীয় মুসলিমরা নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে অস্বস্তিতে ভুগতে শুরু করে: তাদের সমস্যাদি আধুনিক কালের মুসলিমদের সামনে এসে দাঁড়ানো বহু অসুবিধা ও বিতর্কের পূর্বাভাস হিসাবে কাজ করেছে। তারা অনুভব করতে শুরু করে যে এমন এক দেশের বিচ্ছিন্ন সংখ্যালঘু গোষ্ঠী তারা যেটি অটোমান সাম্রাজ্যের আনাতোলিয় কেন্দ্রভূমির সীমান্তবর্তী এলাকা নয়; বরং সভ্য জগতের অন্যতম প্রধান সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমি। কেবল হিন্দু এবং শিখদের মোকাবিলা করছে না তারা, ব্রিটিশরাও শক্তিশালী বাণিজ্যিক অস্তিত্ব গড়ে তুলছে, যা উপমহাদেশে ক্রমবর্ধমানহারে রাজনৈতিক রূপ নিচ্ছিল। প্রথমবারের মত মুসলিমরা শয়তান কর্তৃক শাসিত হবার আশঙ্কার মুখোমুখি হল। ইসলামী ধার্মিকতার ক্ষেত্রে উম্মাহর গুরুত্বের বিচারে এটা ছিল গভীর উদ্বেগজনক। কেবল রাজনৈতিক ব্যাপার ছিল না এটা, বরং তাদের অস্তি ত্বের গভীরতম প্রদেশ স্পর্শ করেছিল। ভারতে মুসলিমদের জীবনে এক নয়া নিরাপত্তাহীনতার বোধ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। ইসলাম কী তবে স্রেফ আরেকটি হিন্দু বর্গ হয়ে দাঁড়াবে? মুসলিমরা কী তাদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলবে এবং ইসলামের জন্মভূমি মধ্যপ্রাচ্যের চেয়ে আলাদা ভিনদেশী সংস্কৃতির তোড়ে ভেসে যাবে? তবে কী শেকড়ের সঙ্গে সংযোগ চ্যুত হয়েছে তারা?
সুফি চিন্তাবিদ শাহ্ ওয়ালি-উল্লাহ্ (১৭০৩-৬২) বিশ্বাস করতেন, সমাধান নিহিত রয়েছে সিরহিন্দির প্রস্তাবনায় এবং তাঁর মতামত ভারতের মুসলিমদের ওপর একেবারে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করেছিল। নতুন সংগ্রামী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন তিনি। এদিকে মুসলিমরা যখন তাদের ক্ষমতা বিশ্বের অন্য অংশে চলে যাচ্ছে ভেবে ইসলামের টিকে থাকার প্রশ্নে একই রকম শঙ্কা অনুভব করছিল, দার্শনিক ও সংস্কারকগণও সমরূপ উপসংহার পৌঁছেছেন। প্রথমত: মুসলিমদের অবশ্যই গোত্রীয় ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রণাঙ্গনে দাঁড়াতে হবে। উপমহাদেশের বিশেষ পরিস্থিতির দাবী মেটাতে শরিয়াহকে অবশ্যই পরিমার্জনা করতে হবে এবং হিন্দুকরণ প্রতিরোধের উপায়ে পরিণত হতে হবে একে। সামরিক ও রাজনৈতিক প্রাধান্য বজায় রাখা মুসলিমদের জন্যে অত্যাবশ্যক। শাহ্ ওয়ালি উল্লাহ্ এত বেশী উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, তিনি এমনকি মুসলিম শক্তির পুনর্জাগরণের স্বার্থে ধ্বংসাত্মক আফগান প্রয়াসেও সমর্থন দিয়েছিলেন। মুসলিমদের চিন্তা জগতে একটা আত্মরক্ষামূলক চাপ যোগ হয়েছিল এবং তা আধুনিক যুগের মুসলিমদের ধার্মিকতার একটা বৈশিষ্ট্য রয়ে গেছে।
অটোমান সাম্রাজ্য
১৪৫৩তে অটোমানরা যখন কনস্ট্যান্টিনোপল অধিকার করে নেয় (যা এখন ইসতাম্বুল নামে পরিচিত), একটা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মত অবস্থানে পৌঁছে যায় তারা; আস্তে আস্তে সাম্রাজ্যটি গড়ে উঠতে পেরেছিল বলে অন্যান্য সাম্রাজ্যের তুলনায় এর ভিত্তি ছিল অনেক দৃঢ়, ফলে তা সর্বাধিক সাফল্যমণ্ডিত এবং স্থায়ী হয়ে ওঠে। প্রাথমিক পর্যায়ের অটোমান গোত্রপতিরা আর পাঁচজন গাজী শাসকদের মতই ছিলেন, কিন্তু ইস্তাম্বুলে সুলতানগণ বাইযানটাইনদের আদলে রাজদরবারের ব্যাপক আনুষ্ঠানিকতা বিশিষ্ট এক চরম রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। অবশ্য রাষ্ট্রের কাঠামোর ভিত্তি ছিল প্রধানত পুরনো মঙ্গোল আদর্শ, সুলতানের ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণাধীন বিশাল সেনাবাহিনীকে কেন্দ্রীয়ক্ষমতা হিসাবে বিবেচনা করা হত। মেহমেদ, দ্য কনকোয়েরার-এর ক্ষমতার ভিত্তি ছিল বলকান অভিজাত গোষ্ঠীর সমর্থন– যাদের অনেকেই তখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল; আর পদাতিক বাহিনী–”নয়া সেনাদল” (ইয়েনি চেরি-yeni cheri) — গানপাউডার আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে যা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল। বহিরাগত হিসাবে ধর্মান্তরিত ক্রীতদাস জোনিসারিদের জমিজমার প্রতি কোনও আগ্রহ ছিল না, ফলে তারা সুলতানদের নিরেট প্রতিরক্ষা বুহ্য হিসাবে এক স্বাধীন বাহিনীতে পরিণত হয়। অটোমানরা তাদের পুরনো আদর্শের বৈশিষ্ট্যও বজায় রেখেছিল: নিজেদের তারা ইসলামের শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদে নিবেদিত এক সীমান্ত রাজ্যের কর্মী দল হিসাবে দেখেছে। পশ্চিমে তাদের সামনে ছিল ক্রিশ্চান জগৎ আর পুবে শিয়া সাফাভীয়রা। অটোমানরাও সাফাভীয়দের মত তীব্র সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে, অটোমান সাম্রাজ্যে বসবাসরত শিয়াদের বিরুদ্ধে গণহত্যার ঘটনা ঘটে।