অবশ্য ইসমায়েলের বিপরীতে আকবর প্রজাদের দমন বা তাদের ওপর নির্যাতন চালাননি, কিংবা তাদের আপন ধর্ম বিশ্বাসে দীক্ষা দেয়ার প্রয়াসও পাননি। যদি তা করতেন, তাঁর সাম্রাজ্য টিকে থাকতে পারত না। মুসলিমরা এমন এক দেশে সংখ্যালঘু শাসক ছিল সেখানে কখনও ধর্মীয় একরূপতা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলেনি। প্রত্যেক হিন্দুবর্গের নিজস্ব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ছিল এবং বুদ্ধ, জ্যাকবাইট, ইহুদি, জৈন, ক্রিশ্চান, যরোস্ট্রিয়, সুন্নী মুসলিম এবং ইসমায়েলিরা কোনও রকম বাধা-বিপত্তি ছাড়াই উপাসনা করার অনুমতি পেয়ে আসছিল। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে সকল বর্গের হিন্দু, এবং এমনকি কিছু সংখ্যক মুসলিমও একেশ্বরবাদের এক আধ্যাত্মবাদী ধ্যানধর্মী ধরন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একত্রিত হয়েছিল, যেখানে সবরকম সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতাকে ত্যাগ করা হয়। গুরু নানক (মৃত্যু: ১৪৬৯) প্রতিষ্ঠিত শিখ ধর্ম এইসব গোষ্ঠী হতে গড়ে উঠেছিল, এখানে হিন্দু ধর্ম ও ইসলামের ঐক্য ও সংহতির ওপর জোর দেয়া হয়েছে। অবশ্য আক্রমণাত্মক বিরোধিতার একটা সম্ভাবনা সবসময়ই ছিল। ভারতে বিশ্বজনীনতা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং কোনও অসহিষ্ণু নীতি ভারতীয় সংস্কৃতির মূলসুর বিরোধী হয়ে দাঁড়াত। মুসলিম শাসকগণ এটা আগে থেকেই জানতেন, সেজন্য তাঁরা সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনে হিন্দুদের নিয়োগ দিয়েছেন। আকবর এই ঐতিহ্যকে আরও জোরদার করে তোলেন। তিনি জিম্মিদের ক্ষেত্রে শরিয়াহ্ কর্তৃক জারি করা জিযিয়াহ্ কর বাতিল করে দেন, হিন্দু অনুভূতিকে আঘাত না করার জন্যে নিরামিষ-ভোজীতে পরিণত হন এবং শিকারে ইস্তফা দেন (এ ক্রীড়াটি দারুণ উপভোগ্য ছিল তাঁর)। আকবর সকল ধর্মকে শ্রদ্ধা করতেন। হিন্দুদের জন্যে মন্দির নির্মাণ করেছেন তিনি। ১৫৭৫-এ তিনি এক “উপাসনা গৃহ” স্থাপন করেছিলেন যেখানে সকল ধর্মের পণ্ডিত ব্যক্তিগণ আলোচনার উদ্দেশ্যে মিলিত হতে পারতেন। “স্বর্গীয় একেশ্বরবাদের (devine monotheism তাওহীদ-ই ইলাহী) প্রতি নিবেদিত নিজস্ব সুফি মতবাদও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি, যা কুরানের একজন মাত্র ঈশ্বর সঠিকভাবে পরিচালিত যেকোনও ধর্মে নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন, এই বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
যদিও নিঃসন্দেহে এটা কুরানের চেতনার প্রতি বিশ্বস্ত ছিল, কিন্তু আকবরের বহুত্ববাদ (Pluralism) কোনও কোনও শরিয়াহ্ গোষ্ঠীর মাঝে গড়ে ওঠা কট্টর সাম্প্রদায়িক মনোভাবের একেবারে বিপরীত ছিল এবং সাম্প্রতিক শিয়া/সুন্নী বিরোধের গোঁড়ামির তুলনায় কয়েক আলোকবর্ষ দূরবর্তী। কিন্তু অন্য যেকোনও নীতি ভারতে রাজনৈতিক দিক দিয়ে বিপর্যয়কর হয়ে দাঁড়াত। রাজত্বের গোড়ার দিকে উলেমাদের প্রশ্রয় দিয়েছেন আকবর, কিন্তু তিনি কখনওই শরিয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর নিজস্ব ঝোঁক ছিল সুফিবাদ ও ফালসাফার দিকে, এ দুটোই ঝুঁকে ছিল এক বিশ্বজনীন দর্শনের প্রতি। ফায়লাসুদের বর্ণিত আদর্শ সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন আকবর। তাঁর জীবনীকার সুফি ঐতিহাসিক আবদুলফযল আল্লামি (১৫৫১-১৬০২) আকবরকে একজন আদর্শ দার্শনিক-রাজা হিসাবে দেখেছেন। তিনি এটাও বিশ্বাস করতেন যে তিনি (আকবর) ছিলেন আদর্শ মানুষ ( Perfect Man), সুফিদের ধারণানুযায়ী উম্মাহকে ঐশী নির্দেশনা দেয়ার জন্য যিনি প্রতি প্রজন্মের মাঝে অবস্থান করেন। আকবর এমন এক সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যা, যুক্তি দেখিয়েছেন আল্লামি, মানুষকে এমন এক উদার চেতনাবোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করত যার ফলে বিবাদ-বিসম্বাদ অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত। এই নীতি সুফি আদর্শ সুহল-ই কুল (“বিশ্বজনীন শান্তি”) প্রকাশ করে, এটা মাহব্বাত-ই কুল, “বিশ্বজনীন ভালোবাসার” সূচনা মাত্র, মানবজাতির জাগতিক ও আধ্যাত্মিক কল্যাণের সন্ধান করবে যা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে গোঁড়ামি অর্থহীন; আকবরের মত আদর্শ ফায়লাসুফ রাজা সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার ঘৃণ্য কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে।
মুসলিমদের কেউ কেউ অবশ্য আকবরের ধর্মীয় বহুত্ববাদে আক্রান্ত বোধ করেছে। আমাদ সিরহিন্দি (মৃত্যু: ১৬২৫), যিনি নিজেও সুফি ছিলেন, মনে করেছেন বিশ্বজনীনতা (যার জন্যে ইবন আল-আরাবিকে দায়ী করেন তিনি) বিপজ্জনক। সিরহিন্দি ঘোষণা করেন যে, আকবর নন, বরং তিনিই যুগের আদর্শ মানব (Perfect Man)। একমাত্র তখনই ঈশ্বরের নৈকট্য পাওয়া যাবে মানুষ যখন নিবেদিতভাবে শরিয়া আইন মেনে চলবে, এই পর্যায়ে যাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আরও সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠছিল। অবশ্য সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমাংশে ভারতের স্বল্প সংখ্যকে মুসলিমই সিরহিন্দির দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সমর্থন জুগিয়েছিল। আকবরের পৌত্র শাহ্ জিহান, যিনি ১৬২৭ থেকে ১৬৫৮ পর্যন্ত শাসন পরিচালনা করেছেন, আকবরের নীতি বজায় রাখেন। তাঁর তাজমহল হিন্দুদের স্থাপত্য কৌশলের সঙ্গে মুসলিমদের স্থাপত্য কলার মিশ্রণের পিতামহের ঐতিহ্য অব্যাহত রেখেছে। রাজদরবারে তিনি হিন্দু কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন আর মুসলিম বৈজ্ঞানিক রচনাবলী সংস্কৃত ভাষায় অনূদিত হয়। কিন্তু সুফিবাদের প্রতি বৈরী ছিলেন শাহ্ জিহান, তাঁর ধর্মানুরাগ আকবরের তুলনায় অনেক বেশী শরিয়াহ ভিত্তিক ছিল।