কিন্তু উলেমাদের কেউ কেউ পুরনো শিয়া ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বস্ত রয়ে গিয়েছিলেন; তাদের ধ্যান-ধারণা বর্তমান কালেও, কেবল ইরানে নয়, বরং গোটা বিশ্বের সংস্কারক ও বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা জোগায়। মির দিমাদ (মৃত্যু: ১৬৩১) এবং তাঁর শিষ্য মোল্লা সদরা (মৃত্যু: ১৬৪০) ইসফাহানে অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনের এক মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, মজলিসি এর দমনে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়েছেন। দর্শন ও আধ্যাত্মিকতাকে একত্রিত করার সুহরাওয়ার্দির ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন তাঁরা; অনুসারীদের অতীন্দ্রিয়বাদী অনুশীলন শিক্ষা দিয়েছেন যাতে করে তারা আলম আল- মিথাল এবং আধ্যাত্মিক জগতের অনুভূতি লাভে সফল হয়ে উঠতে পারে। দু’জনই জোর দিয়ে বলেছেন যে, একজন দার্শনিককে অবশ্য অবশ্য অ্যারিস্টটলের মত যুক্তিবাদী ও বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণার অনুসারী হতে হবে, কিন্তু তাকে আবার সত্য আবিষ্কারে কল্পনানির্ভর, সজ্ঞামূলক দৃষ্টিভঙ্গিও গড়ে তুলতে হবে। উলেমাদের সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার ব্যাপারে দু’জনই দারুণ বিরূপ ছিলেন, একে তাঁরা ধর্মের বিকৃতি হিসাবে দেখেছেন। শক্তির দ্বারা সত্য আরোপ করা যায় না এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সমরূপতাবাদ (Intellectual Conformism) প্রকৃত ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে বেমানান। মোল্লা সদরা রাজনৈতিক সংস্কারকে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হিসাবেই দেখেছেন। তাঁর প্রধান রচনা আল-আফসান আল-আরবাহ্ (দ্য ফোরফোল্ড জার্নি- The fourfold Journey)-তে তিনি জাগতিক পৃথিবীকে পরিবর্তনের প্রয়াস নেয়ার আগে একজন নেতার যেসব অতীন্দ্রিয়বাদী প্রশিক্ষণ নেয়া আবশ্যক সেসবের বর্ণনা দিয়েছেন। সবার আগে তাঁকে অবশ্যই অহমবোধ ঝেড়ে ফেলতে হবে, স্বর্গীয় আলোক গ্রহণ করতে হবে আর অর্জন করতে হবে ঈশ্বরর অতীন্দ্রিয় বোধ। এই পথে তাঁরা শিয়া ইমামদের মত, যদিও একই মাত্রার নয়, একই রকম আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করতে পারবে। আয়াতোল্লাহ্ খোমিনি (১৯০২-৮৯) মোল্লা সদরার শিক্ষায় গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন এবং পরলোকগমনের আগে জাতির উদ্দেশে দেয়া শেষ ভাষণে তিনি জনগণকে ইরফানের গবেষণা ও অনুশীলন অব্যাহত রাখার আবেদন জানিয়েছেন, কেননা আধ্যাত্মিক সংস্কার ছাড়া প্রকৃত অর্থে কোনও ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে না।
ইরানের উলেমাদের মাঝে ক্রমশ বিস্তার লাভ করতে থাকা একেবারে নতুন এক ধারণার কারণে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন মোল্লা সদরা, আমাদের বর্তমান কালেও যার চরম রাজনৈতিক পরিণাম রয়ে গেছে। নিজেদের উসুলি বলে দাবীকারী একটা দল বিশ্বাস করত যে সাধারণ মুসলিমরা নিজেরা ধর্মবিশ্বাসের মৌল নীতিমালা (উসুল) ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং তাদের উচিত জ্ঞানী শিক্ষিত উলেমার সন্ধান করা এবং তাঁর আইনি বিধান অনুসরণ করা, যেহেতু একমাত্র তারাই গোপন ইমামের কর্তৃত্ব ধারণ করেন। শিয়া উলেমাগণ কখনওই সুন্নীদের মত “ইজতিহাদের দ্বার” রুদ্ধ করতে রাজি হননি। প্রকৃতপক্ষে, নেতৃস্থানীয় জুরিস্টকে তারা মুজতাহিদ বলে অভিহিত করতেন। মুজতাহিদ- যিনি ইসলামী আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে “স্বাধীন বিচার বুদ্ধি” প্রয়োগের অধিকার লাভ করেছেন। উসুলিদের শিক্ষা ছিল, এমনকি শাহকেও মুজতাহিদ প্রদত্ত ফাতওয়াহ্ মানতে হবে, যাঁকে তিনি মন্ত্রণাদাতা হিসাবে মনোনীত করেছেন, কেননা তাঁর আইনি পরামর্শ শাহ্-র প্রয়োজন। সপ্তদশ শতাব্দীতে উসুলিরা ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করতে পারেনি, কিন্তু শতাব্দীর শেষ নাগাদ, যখন পরিষ্কার হয়ে গেল যে সাফাভীয় সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়েছে, তাদের অবস্থান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রের দুর্বলতার পরিপূরক হিসাবে একটা শক্তিশালী আইনি কর্তৃপক্ষের প্রতিষ্ঠা জরুরি হয়ে পড়েছিল।
সাম্রাজ্য ইতিমধ্যে যে কোনও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির ভাগ্যই বরণ করে নিয়েছিল, নিজের দায়িত্ব পালন করে উঠতে পারছিল না। ব্যবসা-বাণিজ্যের অবনতি ঘটেছিল, বিরাজ করছিল অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা আর শেষ দিকের শাহ্রা ছিলেন অনুপযুক্ত। ১৭২২-এ যখন আফগান গোত্রগুলো ইসফাহানে হামলা চালায়, অপমানজনকভাবে আত্মসমর্পণ করে নগরী। এক সাফাভীয় যুবরাজ হত্যাযজ্ঞ এড়িয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং মেধাবী অথচ নিষ্ঠুর কমান্ডার নাদির খানের সহায়তায় হানাদারদের বিতাড়িত করেন। বিশ বছরেরও বেশী সময় ধরে নাদির খান, যিনি সাফাভীয় সহকর্মীকে বাদ দিয়ে নিজেকে শাহ্ ঘোষণা করেছিলেন, ইরানকে আবার একত্রিত করেন এবং উল্লেখ্যযোগ্য সামরিক বিজয় অর্জন করেন। কিন্তু নির্দয় নিষ্ঠুর মানুষ ছিলেন তিনি এবং ১৭৪৮-এ আততায়ীর হাতে প্রাণ হারান। এই সময়কালে দুটো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ইরানের উলেমাদের এমন এক নজীরবিহীন ক্ষমতার অধিকারী করে তোলে মুসলিম বিশ্বে যা আর কখনও দেখা যায়নি। প্রথমত: নাদির খান যখন অসফলভাবে ইরানে সুন্নী ইসলাম পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস পেয়েছিলেন, নেতৃস্থানীয় উলেমাগণ তখন সাম্রাজ্য ত্যাগ করে নাজাফ ও কারবালা এ দুই পবিত্র শিয়া নগরীতে গিয়ে ওঠেন (যথাক্রমে আলী ও হুসেইনের উদ্দেশ্যে নিবেদিত)। গোড়াতে একে এক বিপর্যয় বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু অটোমান ইরাকের অন্তর্গত নাজাফ ও কারবালায় একটা ভিত্তি পেয়েছিলেন তাঁরা। যেখান থেকে তাঁরা ইরানের জাগতিক শাসকের নাগালের বাইরে থেকে জনগণকে নির্দেশনা দিতে পারতেন। দ্বিতীয়ত, নাদির খানের মৃত্যুর পরবর্তী অন্তর্বর্তী সময়ের অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে, ইরানে যখন কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব বলে কিছুই নেই, উলেমাগণ ক্ষমতার শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসেন- ১৭৭৯-এ টুরকোমান কাজার গোত্রের আকা মুহাম্মদ নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে কাজার বংশ প্রতিষ্ঠা করার পর আবার সেখানে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। উসুলিদের অবস্থান অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়ায় এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ দেখায়, যে উলেমাগণ যেকোনও শাহ্-র চেয়ে কার্যকরভাবে ইরানি জনগণের ভক্তি আর আনুগত্য আদায় করতে পেরেছিলেন।
মোঘল সাম্রাজ্য
সুন্নী ইসলামের বিরুদ্ধে পরিচালিত শাহ্ ইসমায়েলের শিয়া জিহাদের ফলে সৃষ্ট অস্থিরতা ভারতে নতুন মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্যে অংশতঃ দায়ী ছিল। এর প্রতিষ্ঠাতা বাবুর (মৃত্যু: ১৫৩০) ইসমায়েলের মিত্র ছিলেন। সাফাভীয় এবং উযবেকদের মাঝে সংঘটিত যুদ্ধের সময় তিনি শরণার্থী হিসাবে আফগান পার্বত্য অঞ্চলের কাবুলে পালিয়ে যান, সেখানে টিমুর লেঙ্ক প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের অবশিষ্টাংশের নিয়ন্ত্রণভার নিজ হাতে তুলে নেন। এরপর উত্তর ভারতে ক্ষমতার একটা ভিত্তি স্থাপনে সক্ষম হন তিনি, টিমুরের পছন্দ মঙ্গোল কৌশলে অঞ্চলটি পরিচালনার প্রয়াস পান। তাঁর রাজ্যটি টেকেনি এবং ১৫৫৫ অবধি আফগান আমিরদের মাঝে উপদলীয় সংঘাত বজায় থাকে, তখন বাবুরের সবচেয়ে সক্ষম বংশধর হুমায়ুন সিংহাসন দখল করে নেন এবং যদিও এর পরপরই মৃত্যু ঘটেছিল তাঁর, একজন নির্ভরযোগ্য রিজেন্ট ১৫৬০-এ হুমায়ুনের পুত্র আকবর (১৫৪২-১৬০৫) সাবলকত্ব লাভের আগ পর্যন্ত “মঙ্গোল” (বা “মোঘুল”) ক্ষমতা অটুট রাখেন। উত্তর ভারতে একটি সংহত রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন আকবর, এখানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শাসক হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেন তিনি। সরাসরি সুলতানের অধীনে এক সেনাবাহিনীর আদলে মঙ্গোলদের অনুসরণে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা কৌশল ধরে রেখেছিলেন তিনি। দক্ষ আমলাতন্ত্র গড়ে তোলেন তিনি এবং আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে অন্য মুসলিম শাসকদের সর্বনাশ করে তাঁর মোঘল সাম্রাজ্য বিস্তার ঘটাতে শুরু করেন, যতক্ষণ না হিন্দুস্তান, পাঞ্জাব, মালভা এবং দক্ষিণাত্য তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন হয়।