শাহ্ ইসমায়েল এক সামরিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কিন্তু সাধারণ নাগরিকদের ওপর দারুণ আস্থা ছিল তাঁর, যারা প্রশাসন পরিচালনা করত। অতীতের স্যাসানীয় ও আব্বাসীয় সম্রাটদের মত শাহকে “পৃথিবীতে ঈশ্বরের ছায়া” হিসাবে অভিহিত করা হত; কিন্তু সাফাভীয় বৈধতার ভিত্তি ছিল ইসমায়েলের নিজেকে ইমামদের বংশধর হিসাবে দাবী। অবশ্য সাফাভীয়দের এটা উপলব্ধি করতে সময় লাগেনি যে প্রতিপক্ষদের মাঝে বিপ্লবী উদ্দীপনা জাগিয়ে দেয়া তাদের চরমপন্থী আদর্শ সরকারের আসীন হবার পর আর তেমন একটা কাজে আসবে না। শাহ্ প্রথম আব্বাস (১৫৮৮-১৬২৯) ঘুলুউ আদর্শে অনুপ্রাণিত আমলাদের বাদ দিয়ে জনগণকে দ্বাদশবাদী শিয়া মতবাদের অধিকতর অর্থোডক্স রূপ শিক্ষা দেয়ার জন্যে বিদেশ থেকে আরব শিয়া উলেমাদের আমদানি করেন, তাদের জন্যে মাদ্রাসা নির্মাণ করেন, মুক্ত হাতে আর্থিক সমর্থন দেন তাদের। আব্বাসের অধীনে সাম্রাজ্য এর তুঙ্গ অবস্থায় পৌঁছে যায়। অটোমানদের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত বিজয় অর্জন করেন তিনি এবং তাঁর রাজধানী ইসফাহান এক সাংস্কৃতিক রেনেসাঁ প্রত্যক্ষ করে, যা সম্প্রতি ইউরোপে সংঘটিত ইটালীয় রেনেসাঁর মত ওই অঞ্চলের পৌত্তলিক অতীত হতে অনুপ্রেরণা লাভ করেছিল; ইরানের বেলায় এর মানে ছিল প্রাক-ইসলাম যুগের পারসিয়ান সংস্কৃতি। এটা ছিল সেইসব মহান সাফাভীয় চিত্রশিল্পী বিহাদ (Bihzad মৃত্যু: ১৫৩৫) এবং রিয়া-ই-আব্বারি (Riza-i-Abbari, মৃত্যু : ১৬৩৫)-দের সময়, যাঁদের হাতে সৃষ্টি হয়েছিল আলোকোজ্জ্বল ও স্বপ্নীল নানা মিনারাত। ইসফাহান পরিণত হয়েছিল আকর্ষণীয় মসজিদ আর মাদ্রাসাসহ পার্ক, প্রাসাদ আর বিশাল সব খোলা ময়দানের এক অনন্য সাধারণ নগরীতে।
অবশ্য অভিবাসী নতুন উলেমাগণ পড়েছিলেন এক অদ্ভুত অবস্থায়। প্রাইভেট গ্রুপ হিসাবে তাঁরা কখনও নিজস্ব শিয়া মাদ্রাসা পাননি, বরং গবেষণা ও আলোচনার জন্যে পরস্পরের বাড়িতে মিলিত হতেন। নীতিগতভাবে তাঁরা সবসময় সরকারের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেছেন; কিন্তু এবার তাঁদের ইরানের শিক্ষা ও বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থার দায়িত্ব গ্রহণ করার প্রয়োজন দেখা দিল, কাঁধে চাপল সরকারের অন্যান্য ধর্মীয় কার্যক্রমও। শাহ্ তাদের উদার হাতে উপহার আর মঞ্জুরী দান করেন যার কল্যাণে আর্থিক দিক দিয়ে শেষমেষ স্বাধীন হয়ে যান তাঁরা। ধর্ম বিশ্বাসকে তুলে ধরার এমন একটা সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না বলে ভাবলেন তাঁরা, কিন্তু তখনও রাষ্ট্র সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করেছেন, সরকারী পদপদবী প্রত্যাখ্যানকরেছেন, প্রজা হিসাবে পরিগণিত হতে চাননি। তাদের অবস্থান ছিল সম্ভাবনাময়ভাবে শক্তিশালী। দ্বাদশবাদী অর্থোডক্সি অনুযায়ী শাহগণ নন, বরং উলেমাগণই গোপন ইমামের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাফাভীয়রা উলেমাদের সামাল দিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন, সমগ্র ইরানবাসী শিয়া মতবাদে দীক্ষিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁরা পুরোপুরিভাবে নিজেদের অবস্থানের ফায়দা ওঠাতে পারেননি। কিন্তু তাঁদের নতুন ক্ষমতার মানে ছিল দ্বাদশবাদী শিয়া মতবাদের আকর্ষণীয় কিছু বৈশিষ্ট্য চাপা পড়ে যাওয়া। নিজেদের গভীর অতীন্দ্রিয়বাদী ব্যাখ্যা অনুসরণ করার পরিবর্তে তাঁদের কেউ কেউ বরং অক্ষরমুখী হয়ে উঠেছিলেন। মুহাম্মদ বাকির মজলিসি (মৃত্যু: ১৭০০) সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উলেমায় পরিণত হয়েছেন, কিন্তু এক নতুন শিয়া গোঁড়ামি প্রদর্শন করে গেছেন তিনি। উলেমাদের কেবল ফিক্হ’র ওপরই জোর দিতে হবে। মজলিসি ইরানি শিয়াবাদের অতীন্দ্রিয়বাদ ও দর্শনের প্রতি এমন এক অনাস্থা যোগ করেন, যা আজও টিকে আছে।
সমবেত জিকর এবং সুফি সাধকদের কাল্ট-এর মত পুরোনো সুফি ভক্তিবাদের স্থান দখল করার জন্যে মজলিসি জনগণকে শিয়া মূল্যবোধ ও ধার্মিকতা শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে কারবালায় শাহাদাত্বরণকারী হুসেইনের সম্মানে পালিত আচার অনুষ্ঠানের ওপর জোর দেন। সুবিশাল মিছিল আর আবেগময় শোকসঙ্গীত গাওয়া হত, মানুষ বিলাপ আর কান্নায় মত্ত হত তখন। এসব আচার ইরানের প্রধান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে কারবালার করুণ ঘটনা তুলে ধরা আবেগময় নাটক ‘তাজিয়াহ্’র প্রচলন ঘটে যেখানে জনগণ আর নিষ্ক্রিয় দর্শক মাত্র নয়, বরং আবেগময় সাড়া প্রদান করে তারা বুক চাপড়ে কাঁদে, ইমাম হুসেইনের দুর্ভোগের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে তোলে। এইসব আচার এক গুরুত্বপূর্ণ রক্ষা কবচের কাজ করেছে। যখন তারা কাঁদে, কপাল চাপড়ায়, বেসামাল হয়ে কাঁদে, নিজেদের মাঝে শিয়া ধর্মানুরাগের মূল আকাঙ্ক্ষা ন্যায়-বিচারের প্রসঙ্গ জাগিয়ে তোলে দর্শকরা, নিজেদের প্রশ্ন করে কেন সব সময়ই ভালো মানুষেরাই দুর্ভোগের শিকার বলে মনে হয় আর খারাপ বা অশুভ কেন টিকে থাকে। কিন্তু মজলিসি এবং শাগণ এই আচার অনুষ্ঠানের বিপ্লবী সম্ভাবনাকে যত্নের সঙ্গে চাপা দিয়েছেন। আপন গৃহে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হওয়ার বদলে জনগণকে সুন্নী ইসলামের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানোর শিক্ষা দেয়া হয়েছে। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে পরিচালিত সংগ্রামে হুসেইনকে অনুসরণ করার শপথ গ্রহণের পরিবর্তে মানুষকে বলা হয়েছে তাঁকে একজন পৃষ্ঠপোষক হিসাবে দেখার জন্যে যিনি তাদের স্বর্গলাভ নিশ্চিত করতে পারবেন। আনুষ্ঠানিকতাকে এভাবে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার উপায় বানানো হয়েছিল। জনগণকে তাগিদ দেয়া হয়েছে ক্ষমতাবানদের তোষামোদ আর কেবল নিজেদের স্বার্থের কথা ভাববার। ইরানি বিপ্লব (১৯৭৮-৭৯) অনুষ্ঠিত হবার আগে আর কাল্ট দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের বিরুদ্ধে নির্যাতিত জনগণের ক্ষোভ প্রকাশের উপায় হতে পারেনি