কিন্তু পুরনো সমস্যা রয়েই যায়। চরম অধিপতিকে যত ধার্মিক বলেই মনে হোক না কেন, এই ধরনের একনায়কতন্ত্র মৌলিকভাবে কুরানের চেতনা বিরোধী। অধিকাংশ লোক তখনও চরম দারিদ্র্যের মাঝে বসবাস করত এবং কৃষিভিত্তিক সমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য অনাচার-অবিচারের শিকার ছিল তারা। নতুন নতুন সমস্যাও দেখা দিয়েছিল। মোঘুল ভারত এবং অটোমান সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্ৰ আনাতোলিয়া, এ দুই জায়গাতেই মুসলিমরা আপেক্ষিকভাবে নবাগত ছিল। উভয়েরই তাদের অমুসলিম প্রজাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি শেখার প্রয়োজন ছিল, যারা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। শিয়া সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা সুন্নী ও শিয়াদের মাঝে এক নতুন ও অনতিক্রম্য ভাঙন সৃষ্টি করে, জন্ম দেয় অসহিষ্ণুতা আর আক্রমণাত্মক সাম্প্রদায়িকতাবাদের যা ইসলামী জগতে ছিল নজীরবিহীন– একই সময়ে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়া ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্টদের তিক্ত বিরোধের অনুরূপ। খোদ ইউরোপের চ্যালেঞ্জও ছিল, এতদিন পর্যন্ত মুসলিমদের চোখে যা ছিল পশ্চাদপদ এলাকা, আগ্রহ জাগানোর অনুপযুক্ত। ইউরোপ অবশ্য কৃষিভিত্তিক সমাজের সকল সমস্যা হতে মুক্ত সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এক সমাজ গঠন করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল মাত্র, যা শেষপর্যন্ত পাশ্চাত্যকে কেবল ইসলামী বিশ্বকে অতিক্রমই নয় বরং বশীভূত করায় সক্ষম করে তুলেছিল। নতুন ইউরোপ পেশীশক্তি পরখ করছিল কেবল, তবে ষোড়শ শতাব্দীতে তখনও প্রকৃত হুমকি হয়ে ওঠেনি। রাশানরা যখন মুসলিম কাযান ও অস্ত্রাখানে আক্রমণ চালিয়ে (১৫৫২-৫৬) সেখানে খ্রিষ্টধর্ম চাপিয়ে দেয়, উত্তর ইউরোপে নতুন বাণিজ্য পথ খোলার মাধ্যমে লাভবান হয়েছিল মুসলিমরা। ১৪৯২-তে যে ইবারীয় (Iberian) পর্যটকরা আমেরিকা আবিষ্কার করেছিল, পৃথিবীর চারপাশে খুলে দিয়েছিল নতুন নতুন নৌপথ, পর্তুগিজ বণিকদের চলিষ্ণুতা বাড়িয়ে দেয় তারা। ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে লোহিত সাগরীয় এলাকায় নিও-ক্রুসেড পরিচালনার মাধ্যম তারা দক্ষিণ সাগরে মুসলিম বাণিজ্য ধ্বংস করার প্রয়াস পায়। পর্তুগিজদের এসব হামলা পাশ্চাত্যের কাছে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ইসলামী জগতে তেমন একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। ইরানে শিয়া সাম্রাজ্য গড়ে তোলার ব্যাপারেই মুসলিমরা বেশী আগ্রহী ছিল, প্রাথমিক সাফাভীয়দের অসাধারণ সাফল্য সুন্নী প্রত্যাশার ওপর এক বিরাট আঘাত ছিল। কয়েক শতাব্দী সময়কালের মধ্যে প্রথমবারের মত ইসলামী রাজ্যের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে এক স্থিতিশীল, শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী শিয়া রাষ্ট্রের পত্তন ঘটেছিল।
সাফাভীয় সাম্রাজ্য
দ্বাদশবাদী শিয়া মতবাদ গ্রহণকারী আযেরবাইজানের সাফাভীয় সুফি ধারার অনুসারীরা কিছুদিন ধরেই জর্জিয়া ও ককেসাসের ক্রিশ্চান অধিবাসীদের বিরুদ্ধে ঘায়ু ( Ghazu) হামলা চালিয়ে আসছিল, কিন্তু তারা মেসোপটেমিয়া ও পশ্চিম ইরানের আমিরদের ক্রোধেরও শিকার হয়েছিল। ১৫০০তে ষোল বছর বয়স্ক ইসমায়েল এই ব্যবস্থার পির পদে অধিষ্ঠিত হয়ে আমিরদের হাতে নিহত পিতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের প্রয়াস পান। ১৫০১-এ অভিযানের এক পর্যায়ে তাব্রিয অধিকার করেন ইসমায়েল এবং পরবর্তী এক দশক সময়কালে ইরানের বাকি অংশ অধিকার করে চলেন। তিনি দ্বাদশবাদী শিয়াবাদ তাঁর নতুন সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম হবে বলে ঘোষণা দেন।
বিস্ময়কর পরিবর্তন ছিল এটা। এর আগ পর্যন্ত অধিকাংশ শিয়াই ছিল আরব। ইরানের রাঈ, কাশান, খুরাসান ও পুরনো গ্যারিসন শহর কুম-এ শিয়া কেন্দ্র ছিল বটে, কিন্তু সিংহভাগ ইরানিই ছিল সুন্নী। তো ইরান থেকে সুন্নী মতবাদ নিশ্চিহ্ন করার কাজে নামেন ইসমায়েল: সুফি তরিকাহ্ সমূহকে দমন করা হয়; উলেমাদের হত্যা করা হয় নয়ত পাঠানো হয় নির্বাসনে। প্রশাসনের সদস্যদের জন্যে প্রথম তিন রাশিদুনকে অভিশম্পাত দেয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে–যাঁরা বৈধভাবে আলীকে প্রদত্ত ক্ষমতা “জোর করে ছিনিয়ে” নিয়েছিলেন। অতীতে কখনও কোন শিয়া শাসক এমন ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে নির্যাতনের এক নতুন ক্ষমতার যোগান দিচ্ছিল। পূর্ববর্তী দুশো বছর ধরে শিয়া ও সুন্নীদের মাঝে একটা আঁতাত ছিল। কয়েক শতাব্দী ধরে শিয়াবাদ ছিল গোপন অতীন্দ্রিয়বাদী গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় যারা গোপন ইমামের অনুপস্থিতিতে কোনও সরকার বৈধ হতে পারে না বিশ্বাস করে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল। কীভাবে একটা “রাষ্ট্রীয় শিয়াবাদে”র অস্তিত্ব থাকতে পারে? কিন্তু শাহ্ ইসমায়েল এই যুক্তিতে টলেননি। সম্ভবত: দ্বাদশবাদী অর্থোডক্সি সম্পর্কে বেশী কিছু জানতেন না তিনি, কেননা তিনি তরিকাসমূহের চরমপন্থী ঘুলুউ শিয়াবাদের লোক-গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন, যারা বিশ্বাস করত মেসিয়ানিক কল্পরাজ্য সমাসন্ন। অনুসারীদের কাছে নিজেকে হয়ত গোপন ইমাম হিসাবেই তুলে ধরেছিলেন তিনি, শেষ জমানার যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্যে ফিরে এসেছেন। সুন্নী ইসলামের বিরুদ্ধে পরিচালিত তাঁর জিহাদ ইরানেই শেষ হয়নি। ১৫১০-এ তিনি সুন্নী উযবেকদের খুরাসান থেকে বিতাড়ন করেন এবং তাদের ওক্সাসের উত্তরে ঠেলে দেন; সুন্নী অটোমানদেরও আক্রমণ করেন তিনি, কিন্তু ১৫১৪-তে চ্যান্ডিরানের যুদ্ধে সুলতান প্রথম সেলিমের কাছে পরাস্ত হন। আপন রাজ্যের বাইরে সুন্নীদের ধ্বংস করার তাঁর প্রয়াস ব্যর্থ হয়, কিন্তু ইরানের অভ্যন্তরে তাঁর আক্রমণ সফল হয়েছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ অধিকাংশ ইরানি প্রবলভাবে শিয়া হয়ে যায় এবং আজ পর্যন্তও তাই আছে।