কিন্তু ৬৪৪-এর নভেম্বরে মদীনার মসজিদে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষুব্ধ এক পারসিয়ান যুদ্ধ বন্দীর হাতে উমর ছুরিকাহত হলে বিজয়ের এই ধারা আকস্মিকভাবে রুদ্ধ হয়ে যায়। রাশিদুন এর শেষ দিকের বছরগুলো ছিল সহিংসতায় আকীর্ণ। উসমান ইবন আফফান পয়গম্বরের সহচরদের ছয়জন দ্বারা খলিফাহ্ নির্বাচিত হয়েছিলেন। পূর্বসূরীদের তুলনায় দুর্বল ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি, কিন্তু তাঁর আমলের প্রথম ছ’টি বছর উম্মাহর সমৃদ্ধি অব্যাহত ছিল। উসমান চমৎকার শাসনকাজ পরিচালনা করেছেন; মুসলিমরাও নতুন নতুন অঞ্চল দখল করেছে। তারা বাইযানটাইনদের কাছ থেকে সাইপ্রাস ছিনিয়ে নিয়ে অবশেষে তাদের (বাইযানটাইন) পূর্ব- ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা থেকে উৎখাত করে, এবং উত্তর আফ্রিকায় সেনাদল বর্তমান লিবিয়ার ত্রিপোলি পর্যন্ত পৌঁছে যায়। পুবে, মুসলিম বাহিনী আর্মেনিয়ার অধিকাংশ এলাকা দখল করে, প্রবেশ করে ককেশাস এবং ইরানের ওক্সাস নদী অবধি, আফগানিস্তানের হেরাত আর ভারতীয় উপমহাদেশের সিন্ধে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করে।
কিন্তু এসব বিজয় সত্ত্বেও সৈন্যরা অসন্তুষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছিল তাদের ভেতর। মাত্র এক দশক সময়কালের মধ্যে তারা একটি কঠিন যাযাবর জীবনধারার বিনিময়ে এক পেশাদার সেনাবাহিনীর একেবারে ভিন্ন জীবন ধারা বেছে নিয়েছিল। গ্রীষ্মকাল যুদ্ধ করে আর শীতকালে বাড়ি থেকে দূরে গ্যারিসন শহরে দিন কাটাচ্ছিল তারা। দূরত্ব ব্যাপক হয়ে ওঠায় সমর অভিযানগুলো ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছিল, আগের তুলনায় লুণ্ঠিত মালের পরিমাণও গিয়েছিল কমে। উসমান তখনও বর্তমান ইরাকের মত দেশগুলোয় সেনাপ্রধান ও ধনী মক্কাবাসী পরিবারগুলোকে ব্যক্তিগত এস্টেট স্থাপনের অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিলেন। এটা তাঁর জনপ্রিয়তা কমিয়ে দেয়, বিশেষ করে কুফাহ্ এবং ফুস্ট্যাস্টে। নিজ উমাঈয়াহ্ পরিবারের সদস্যদের সম্মানজনক পদ দেয়ার ভেতর দিয়ে মদীনার মুসলিমদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছিলেন উসমান। তারা তাঁর বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তুলেছে, যদিও উমাঈয়াহ্ কর্মকর্তাদের অনেকেরই অনেক যোগ্যতা ছিল। উদাহরণস্বরূপ, উসমান মুহাম্মদের (স:) পুরনো শত্রু আবু সুফিয়ানের পুত্র মুয়াবিয়াকে সিরিয়ার গভর্নর নিয়োগ দেন। ভাল মুসলিম ছিলেন তিনি, দক্ষ প্রশাসকও; ধীরস্থির চরিত্র এবং পরিস্থিতি বোঝার দক্ষতার জন্য সুপরিচিত ছিলেন। কিন্তু মদীনার মুসলিমদের চোখে, যারা তখনও নিজেদের পয়গম্বরের আনসার (সাহায্যকারী) হিসাবে গর্ব করছিল, অন্যায় বলে মনে হয়েছে, আবু সুফিয়ানের বংশধরের স্বার্থে তাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে ভেবেছে তারা। কুরান- আবৃত্তিকারীগণ, যাদের ঐশীগ্রন্থ মুখস্থ ছিল, তারা প্রধান ধর্মীয় কর্তৃপক্ষে পরিণত হয়েছিল এবং উসমান যখন গ্যারিসন শহরগুলোয় পবিত্র বিবরণের কেবল একটি পাঠ ব্যবহার করার ওপর জোর দেন তখন তারাও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। অন্যান্য পাঠ তিনি বাদ দেন, যা তাদের অনেকেরই পছন্দের ছিল, যদিও সামান্য পার্থক্য ছিল সেসবে। ক্রমবর্ধমান হারে অসন্তুষ্ট গোষ্ঠীটি পয়গম্বরের চাচাত ভাই আলী ইবন আবি তালিবের মুখাপেক্ষী হতে শুরু করে; উমর এবং উসমান উভয়ের নীতির বিরোধী ছিলেন আলী, কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে “সেনাদলের অধিকারে”র পক্ষে ছিলেন তিনি।
৬৫৬ সালে অসন্তোষ স্পষ্ট বিদ্রোহে রূপ নেয়। আরব সেনাদের একটা দল প্রাপ্য বুঝে নিতে ফুস্ট্যাট থেকে মদীনায় ফিরে এসেছিল, তাদের বঞ্চনার মাধ্যমে বিদায় করা হলে তারা উসমানের সাধারণ বাড়ি অবরোধ করে, জোর করে ভেতরে প্রবেশ করে হত্যা করে তাঁকে। বিদ্রোহীরা আলীকে নতুন খলিফাহ্ হিসাবে ঘোষণা করে।
প্রথম ফিৎনাহ্
আলীকেই যোগ্যতম প্রার্থী বলে মনে হয়েছে। পয়গম্বরের আপন নিবাসে বেড়ে উঠেছেন তিনি এবং মুহাম্মদ(স:) কর্তৃক প্রচারিত আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। দক্ষ সৈনিক ছিলেন তিনি, সৈন্যদের উৎসাহ জুগিয়ে চিঠি লিখেছেন আজও যেগুলো ধ্রুপদী মুসলিম বিবরণ হিসাবে টিকে আছে; তিনি ন্যায় বিচারের প্রয়োজনীয়তা শিক্ষা দিয়েছেন, প্রজা সাধারণকে ভালোবাসার সঙ্গে দেখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কিন্তু পয়গম্বরের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও তাঁর শাসন সর্বজনীনভাবে গৃহীত হয়নি। মদীনার আনসার এবং উমাঈয়াদের উত্থানে মক্কার অসন্তুষ্ট গোষ্ঠীটির সমর্থন পেয়েছিলেন আলী। তখনও ঐতিহ্যবাহী যাযাবর জীবনযাপনকারী, বিশেষত ইরাকের মুসলিমরাও তাঁকে সমর্থন দিয়েছিল, যাদের কুফাস্থ গ্যারিসন শহর ছিল আলীর শক্তঘাঁটি। কিন্তু উসমানের হত্যাকাণ্ড, যিনি স্বয়ং আলীর মত মুহাম্মদের(স:) মেয়ে জামাই এবং প্রাথমিক ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম ছিলেন, ছিল এক অতিশয় বেদনাদায়ক ঘটনা যা উম্মাহর মাঝে পাঁচ বছর মেয়াদী গৃহযুদ্ধের সূচনা করেছিল, যা ফিৎনাহ্, প্রলোভনের কাল হিসাবে পরিচিত।
সংক্ষিপ্ত সময় ক্ষেপণের পর মুহাম্মদের(স:) প্রিয়তম স্ত্রী আয়েশা তাঁর আত্মীয় তালহা এবং মুহাম্মদের(স:) অন্যতম মক্কাবাসী সহচর যুবায়েরকে নিয়ে উসমানের হত্যাকারীদের বিচার না করায় আলীর ওপর হামলা চালান। সেনাবাহিনী যেহেতু বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে ছিল, বিদ্রোহীরা মদীনা থেকে কুচকাওয়াজ করে বসরা উদ্দেশে এগিয়ে যায়। সমস্যায় পড়েছিলেন আলী। তিনি নিজেও নিশ্চয়ই উসমানের হত্যাকাণ্ডে আঘাত পেয়েছিলেন, একজন ধার্মিক মানুষ হিসাবে ব্যাপারটাকে ক্ষমা করতে পারেননি। কিন্তু তাঁর সমর্থকরা উসমান কুরানের আদর্শ অনুযায়ী ন্যায়সঙ্গতভাবে শাসন করেননি বলে মৃত্যু তাঁর পাওনা ছিল বলে জোর দিচ্ছিল। আলী তাঁর পক্ষাবলম্বনকারীদের ত্যাগ করতে পারেননি, কুফায় আশ্রয় নেন তিনি, সেখানে রাজধানী স্থাপন করেন। এরপর সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে যান বসরার উদ্দেশ্যে এবং অতি সহজে উটের যুদ্ধে বিদ্রোহীদের পরাজিত করেন– এমন নাম হওয়ার কারণ: সেনাদলের সঙ্গে অবস্থানকারী আয়েশা নিজের উটের পিঠে বসে যুদ্ধ অবলোকন করেছিলেন। বিজয় অর্জনের পর আলী তাঁর সমর্থকদের উচ্চপদে আসীন করেন, সম্পদ ভাগ করে দেন তাদের মাঝে, কিন্তু তারপরও তিনি তাদের কুফাহর উর্বর কৃষি জমি সোয়াদকে কুক্ষিগত করার মাধ্যমে পরিপূর্ণ “সৈনিকের অধিকার” প্রদান করেননি। এ এলাকাটি পারসিয়ান সাম্রাজ্যের সিংহভাগ খাজনা যোগাত। নিজ দলকেও সন্তুষ্ট করতে পারছিলেন না তিনি, কেবল তাই নয় উসমানের হত্যাকারীর নিন্দা না জানানোয় নিজের ওপরও গভীর সন্দেহের ছায়া টেনে এনেছিলেন।