অবশ্য একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে রাখা প্রয়োজন যে আরবরা যখন আরব বিশ্ব হতে ছড়িয়ে পড়েছিল তখন তারা “ইসলামে”র প্রবল শক্তি দ্বারা তাড়িত হয়নি। পাশ্চাত্যের লোকেরা প্রায়ই ধরে নেয় যে ইসলাম একটি সহিংস এবং সমরভিত্তিক ধর্ম বিশ্বাস, যা তরবারির মাধ্যমে অধীনস্ত প্রজাদের ওপর চেপে বসেছে। এটা মুসলিমদের সম্প্রসারণের যুদ্ধের ভুল ব্যাখ্যা। এসব যুদ্ধে ধর্মীয় কোনও বিষয় জড়িত ছিল না, উমরও একথা বিশ্বাস করতেন না যে তিনি বিশ্ব দখল করে নেয়ার ঐশী অধিকার লাভ করেছেন। উমর এবং তাঁর যোদ্ধাদের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ছিল একেবারে বাস্তবমুখী: তারা লুণ্ঠন ও সাধারণ কর্মধারার মাধ্যমে উম্মাহর ঐক্য ধরে রাখতে চেয়েছেন। বহু শতাব্দী ধরে আরবরা পেনিনসূলার বাইরের ধনী বসতিগুলোয় হামলা চালানোর চেষ্টা চালিয়ে এসেছিল। পার্থক্য হল এই পর্যায়ে তারা ক্ষমতা– শূন্যতার মুখোমুখি হয়েছিল। পারসিয়া ও বাইযানটিয়াম কয়েক দশক ধরে পরস্পরের বিরুদ্ধে দীর্ঘ এবং শক্তি ক্ষয়কারী লাগাতার যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। দুটো শক্তিই ছিল ক্লান্ত। পারসিয়ায় চলছিল উপদলীয় কোন্দল আর বন্যায় দেশের কৃষিসম্পদ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। স্যাসানিয় বাহিনীর সিংহভাগই ছিল আরব বংশোদ্ভূত, তারা যুদ্ধের সময় আক্রমণকারী শক্তির সঙ্গে যোগ দিয়েছে। বাইযানটিয়ামের সিরিয়া ও উত্তর আফ্রিকার প্রদেশগুলোয় স্থানীয় জনসাধারণ গ্রিক অর্থোডক্স প্রশাসনের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল, আরবীয় আক্রমণের সময় তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি, যদিও মুসলিমরা বাইযানটাইন মূলকেন্দ্র আনাতোলিয়া পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি।
পরবর্তী সময়ে মুসলিমরা এক সুবিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার পর ইসলামী আইন এই বিজয়ের ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়েছে– গোটা বিশ্বকে দার আল-ইসলাম (ইসলামের ঘর), যা দার আল-হার্ব (যুদ্ধের ঘর)-এর সঙ্গে চিরন্তন যুদ্ধে লিপ্ত, এই রকম বিভক্ত করার মাধ্যমে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে মুসলিমরা মেনে নিয়েছে যে এতদিনে তারা তাদের সম্প্রসারণের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে এবং অমুসলিম বিশ্বের সঙ্গে আন্তরিকভাবেই সহাবস্থান করছে। কুরান যুদ্ধ-বিগ্রহকে পবিত্র করেনি। এটা আত্মরক্ষার জন্যে ন্যায়-যুদ্ধের ধারণা গড়ে তুলেছে যার মাধ্যমে শুভ মূল্যবোধ রক্ষা করা যায়, কিন্তু হত্যা আর আগ্রাসনের নিন্দা জানায়। ১৯ এছাড়া একবার পেনিনসূলা ত্যাগ করার পর আরবরা আবিষ্কার করে যে প্রায় সবাই আহল আল- কিতাবের অন্তর্ভুক্ত, ঐশীগ্রন্থধারী জাতি যারা ঈশ্বরের কাছ থেকে সত্য ঐশীগ্রন্থ লাভ করেছে। সুতরাং তাদের জোর করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হয়নি; প্রকৃতপক্ষে অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের আগে ধর্মান্তরকরণকে উৎসাহিত করা হয়নি। মুসলিমরা মনে করেছে ইসলাম ইসমায়েলের বংশধরদের ধর্ম, জুডাইজম যেমন ইসহাকের পুত্রদের ধর্মবিশ্বাস। আরবীয় গোত্রসদস্যরা সবসময়ই অপেক্ষাকৃত দুর্বল আশ্রিতদের (মাওয়ালি) নিরাপত্তা দিয়ে এসেছে। তাদের নয়া সাম্রাজ্যে ইহুদি, ক্রিশ্চান আর যরোস্ট্রিয়ানরা জিম্মি (নিরাপত্তাপ্রাপ্ত প্রজা) তে পরিণত হওয়ার পর তাদের ওপর আর কোনওভাবেই হানা বা আক্রমণ চালানোর উপায় ছিল না। আশ্রিতদের সঙ্গে সদাচরণ করা, তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া, তাদের যেকোনও ক্ষতির প্রতিশোধ গ্রহণ করার ব্যাপারটি আরবদের জন্যে বরাবরই ছিল মর্যাদার প্রশ্ন। সামরিক নিরাপত্তার বিনিময়ে জিম্মিরা পোল ট্যাক্স প্রদান করত এবং কুরানের নির্দেশনা অনুযায়ী নিজস্ব ধর্ম বিশ্বাসের অনুশীলন করার অনুমতি পেত তারা। প্রকৃত পক্ষে, রোমান ক্রিশ্চানদের কেউ কেউ ধর্মবিরোধী মত অবলম্বনের জন্য গ্রিক অর্থোডক্সদের হাতে নির্যাতিত হওয়ায় বাইযানটাইন শাসনের চেয়ে মুসলিমদেরই পছন্দ করেছিল বেশী।
উমর ছিলেন কঠোর শৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। আরব সৈন্যদের বিজয়ের ফল ভোগ করার সাধ্য ছিল না; অধিকৃত সকল এলাকা সেনা প্রধানদের মাঝে বণ্টিত হত না, বরং বর্তমান আবাদীদের হাতেই রাখা হত যারা মুসলিম রাষ্ট্রকে খাজনা প্রদান করত। মুসলিমদের নগরে বসতি করার অনুমতি ছিল না। তার পরিবর্তে বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে নতুন নতুন “গ্যারিসন শহর” (আমসার) নির্মাণ করা হয়েছিল তাদের জন্য: ইরাকের কুফা এবং বসরা, ইরানের কুমে এবং নীল নদের উৎসমুখ, ফুস্ট্যাটে। পুরনো শহরের মধ্যে একমাত্র দামাস্কাসই মুসলিম কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। প্রত্যেকটি আমসারে একটি করে মসজিদ নির্মিত হয় যেখানে মুসলিম সৈন্যরা শুক্রবারের প্রার্থনায় যোগ দিত। এইসব গ্যারিসন শহরে সৈন্যদের ইসলামী জীবনযাপনের শিক্ষা দেয়া হত। উমর পারিবারিক মূল্যবোধের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন, মদ্যপানের বেলায় কোঠর ছিলেন আর পয়গম্বরের সুন্দর বৈশিষ্ট্যসমূহকে উঁচু করে তুলেছেন। খলিফার মত পয়গম্বরও সবসময় সাধাসিধে জীবনযাপন করে গেছেন। তবে গ্যারিসন শহরগুলো আবার আরবীয় ছিটমহলের মতই ছিল যেখানে বিশ্ব সম্পর্কে কুরানের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে খাপ খায় এমন ঐতিহ্যগুলোও বিদেশের মাটিতে অব্যাহত থাকে। এই পর্যায়ে ইসলাম আবিশ্যিকভাবেই আরবীয় ধর্ম ছিল। কোনও জিম্মি ধর্মান্তরিত হলে তাকে বাধ্যতামূলকভাবে যেকোনও একটি গোত্রের “আশ্রিত” (Client) হতে হত এবং সে আরবীয় ব্যবস্থায় অঙ্গীভূত হয়ে যেত।