আবু বকরের শাসনামল (৬৩২-৩৪) ছিল সংক্ষিপ্ত অথচ সঙ্কটময়। তাঁকে প্রধানত তথাকথিত রিদ্দাহ্ (ধর্মত্যাগ)র যুদ্ধ নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়েছিল, বিভিন্ন গোত্র উম্মাহ্ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাদের সাবেক স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছিল তখন। অবশ্য একে ব্যাপক ধর্মীয় পক্ষত্যাগের ঘটনা হিসাবে দেখা ভুল হবে। বিদ্রোহের ঘটনাগুলো একেবারেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ছিল। ইসলামী কনফেডারেসিতে যোগ দেয়া বেশীরভাগ বেদুঈন গোত্রেরই মুহাম্মদের(স:) ধর্মের বিস্তারিত্ব নিয়মকানুনে আগ্রহ ছিল না। বাস্তববাদী পয়গম্বর বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর গঠিত অনেক মৈত্রীই সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, আরবীয় মরুপ্রান্তরে যেমন রেওয়াজ ছিল সে অনুযায়ী একজন গোত্রপতি আরেকজনের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন। কোনও কোনও গোত্রপতি এটা মনে করে থাকতে পারেন যে তাঁদের চুক্তি কেবল মুহাম্মদের(স:) সঙ্গে ছিল, উত্তরাধিকারীর সঙ্গে নয় এবং তাঁর পরলোকগমনের পর তাদের উম্মাহর বিভিন্ন গোত্রের ওপর হামলা চালানোয় আর বাধা নেই, এইভাবে তারা নিজেদের ওপর পাল্টা আঘাত আহ্বান করেছিল।
এটা অবশ্য তাৎপর্যপূর্ণ যে বিদ্রোহীদের অনেকেই তাদের বিদ্রোহকে ধর্মীয় সিদ্ধতা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছিল; নেতারা প্রায়শ: নিজেদের পয়গম্বর দাবী করেছেন এবং কুরানের স্টাইলে “প্রত্যাদেশ” খাড়া করেছেন। আরবরা একটা গভীর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গিয়েছিল। আমাদের আধুনিককালের অর্থ অনুযায়ী এটা “ধর্মীয়” ছিল না, কেননা অনেকের কাছেই এটা ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার ছিল না, অন্তরের দীক্ষা অনুসরণ করেনি তারা। পয়গম্বর পুরনো ছাঁচ ভেঙে ফেলেছিলেন এবং আকস্মিকভাবে- সাময়িক হলেও- আরবরা প্রথমবারের মত নিজেদের লাগাতার শক্তি হ্রাসকারী যুদ্ধ-বিগ্রহের ভার হতে মুক্ত একটা ঐক্যবদ্ধ সমাজের সদস্য হিসাবে আবিষ্কার করেছিল। মুহাম্মদের(স:) সংক্ষিপ্ত শাসনকালে তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন জীবন ধারার আস্বাদ পেয়েছিল, এক ধর্মীয় পরিবর্তন দ্বারা আবদ্ধ হয়েছিল। ঘটে যাওয়া ঘটনাটি এত বিহ্বলকারী ছিল যে এমনকি যারা উম্মাহ্ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চেয়েছে তারাও পয়গম্বরীয় ধারাতেই চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছিল। সম্ভবত: রিদ্দাহ্ যুদ্ধ চলার সময়ই মুসলিমরা এই সব রিদ্দাহ্ পয়গম্বরদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে ধারণা করতে শুরু করে যে মুহাম্মদ(স:) ছিলেন শেষ এবং মহানবী, যে দাবী কুরানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি ৷
প্রজ্ঞা ও ক্ষমাপ্রদর্শনের মাধ্যমে আবু বকর এইসব বিদ্রোহ প্রশমিত করেছেন এবং আরবের ঐক্যপ্রয়াস শেষ করেছেন। তিনি বিদ্রোহীদের অভিযোগ সৃজনশীলতার সঙ্গে সমাধান করেছেন। যারা প্রত্যাবর্তন করেছিল তাদের বিরুদ্ধে কোনও রকম প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কেউ কেউ আশপাশের এলাকায় লোভনীয় ঘায়ু হামলায় অংশ নেয়ার সম্ভাবনা দেখে ফিরে এসেছিল- দ্বিতীয় খলিফা হ উমর ইবন আল-খাত্তাবের (৬৩৪-৪৪) শাসনামলে যা নাটকীয় গতি পায়। এসব হামলা ছিল পেনিনসূলায় প্রতিষ্ঠিত নয়া ইসলামী শান্তি থেকে উদ্ভূত এক সমস্যার প্রতি সাড়া বিশেষ। শত শত বছর ধরে আরবরা তাদের সম্পদের প্রয়োজন মিটিয়ে এসেছিল ঘায়ুর মাধ্যমে, কিন্তু ইসলাম এর অবসান ঘটিয়েছিল, কারণ উম্মাহ্ গোত্র সমূহের পরস্পরের ওপর হামলা চালানোর অনুমোদন ছিল না। ঘায়ুর বিকল্প কী হবে যা মুসলিমদের সামান্য জীবীকা সংগ্রহে সক্ষম করে তুলবে? উমর অনুধাবন করেছিলেন যে, উম্মাত্র শৃঙ্খলা প্রয়োজন। আইন-বিরোধী উপাদানগুলোকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে এবং যে শক্তি এতদিন যাবৎ হানাদারি যুদ্ধ বিবাদে ব্যয়িত হয়েছে তাকে এবার একটি সাধারণ কর্মধারায় চালিত করতে হবে। স্পষ্ট সমাধান ছিল প্রতিবেশী দেশসমূহের অমুসলিম গোষ্ঠীগুলোর ওপর ঘায়ু হামলা পরিচালনা করা। উম্মাহর ঐক্য বাইরের দিকে পরিচালিত আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রক্ষিত হবে। এতে খলিফার কর্তৃত্বও বৃদ্ধি পাবে। আরবরা ঐতিহ্যগতভাবে রাজতন্ত্র অপছন্দ করত আর রাজকীয় আচরণ প্রদর্শনকারী যেকোনও শাসকের প্রতি বিদ্রূপ প্রদর্শন করত। কিন্তু তারা সামরিক অভিযানের সময় বা নতুন কোনও চারণ ভূমির উদ্দেশ্যে যাত্রায় গোত্রপতির কর্তৃত্ব মেনে নিত। সুতরাং উমর নিজেকে আমির আল-মুমীনিন (বিশ্বাসীদের নেতা) বলে আখ্যায়িত করেন, ফলে গোটা উম্মাহর সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে মুসলিমরা তাঁর নির্দেশ বা সমাধান মেনে নিয়েছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে এমন বিষয়ের সিদ্ধান্ত মানেনি।
তো উমরের নেতৃত্বে আরবরা লাগাতার বিস্ময়কর বিজয় অর্জনের ভেতর দিয়ে ইরাক, সিরিয়া এবং মিশরে হাজির হয়েছিল। কাদিসিয়ার যুদ্ধে (৬৩৭) তারা পারসিয়ান সেনাবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে, যার ফলে পারসিয়ান স্যাসানিয় রাজধানী সেসিফনের পতন ঘটে। পর্যাপ্ত লোকবল সংগ্রহ হওয়ামাত্র মুসলিমরা এভাবে গোটা পারসিয়ান সাম্রাজ্য অধিকার করে নিতে সক্ষম হয়। বাইযানটাইন সাম্রাজ্যে তারা কঠিন প্রতিরোধের মুখোমুখি হয় এবং বাইযানটাইনের প্রাণকেন্দ্র আনাতোলিয়ায় কোনও এলাকা দখলে ব্যর্থ হয়। তা সত্ত্বেও, মুসলিমরা উত্তর প্যালেস্টাইনে ইয়ারমুকের যুদ্ধে (৬৩৬) বিজয় লাভ করে এবং ৬৩৮-এ জেরুজালেম অধিকার করে, আর ৬৪১ নাগাদ গোটা সিরিয়া, প্যালেস্টাইন ও মিশরের নিয়ন্ত্রণাধিকার পেয়ে যায়। মুসলিম বাহিনী সুদূর সেরেনাইকা পর্যন্ত উত্তর আফ্রিকান উপকূল দখল করার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়। বদরের যুদ্ধের মাত্র বিশ বছর পর আরবরা নিজেদের এক উল্লেখযোগ্য সাম্রাজ্যের মালিক হিসাবে আবিষ্কার করে। সম্প্রসারণ অব্যাহত থাকে। পয়গম্বরের পরলোকগমনের একশ’ বছর পর, ইসলামী সাম্রাজ্য পিরেনিস থেকে হিমালয় পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। একে আরেকটা অলৌকিক ঘটনা আর ঈশ্বরের অনুগ্রহের লক্ষণ বলে মনে হয়েছে। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের আগে আরবরা ছিল ঘৃণিত অস্পৃশ্য জাতি; কিন্তু আশ্চর্য সংক্ষিপ্ত সময় পরিসরে তারা দু’দুটো প্রধান সাম্রাজ্যের ওপর শোচনীয় পরাজয় চাপিয়ে দিয়েছিল। বিজয়ের অভিজ্ঞতা তাদের মনে এই ধারণা জোরাল করে তোলে যে তাদের ভাগ্যে অসাধারণ একটা কিছু ঘটেছে। এভাবেই উম্মাহর সদস্যপদ ছিল এক দুয়ে অভিজ্ঞতা, কারণ তাদের জানা বা প্রাচীন গোত্রীয় আমলে কল্পনাযোগ্য যেকোনও কিছুকে তা অতিক্রম করে গিয়েছিল। তাদের সাফল্য কুরানের বাণীকেও সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করেছে যেখানে বলা হয়েছে যে সঠিক পথে পরিচালিত সমাজ অবশ্যই সমৃদ্ধি অর্জন করবে কেননা তা ঈশ্বরের আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে আত্মসমৰ্পণ করার ফলে কী পরিবর্তন এসেছে ভাব একবার! ক্রিশ্চানরা যেখানে দৃশ্যত: ব্যর্থতা বা পরাজয়ে ঈশ্বরের ভূমিকা দেখতে পায়, জেসাস যেখানে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে পরলোকগমন করেছেন, মুসলিমরা সেখানে রাজনৈতিক সাফল্যকে পবিত্র হিসাবে অনুভব করেছে, একে তাদের জীবনে স্বর্গীয় সত্তার প্রকাশ হিসেবে দেখেছে।