এটা অন্তত একটা মতবাদ, ১৯১২ সালে প্রকাশিত দ্য অরিজিন অভ দ্য আইডিয়া অভ গড গ্রন্থের মাধ্যমে ফাদার উইলহেম স্মিডট একে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। স্মিডট মত প্রকাশ করেছেন যে, বহু সংখ্যক দেব-দেবীর উপাসনা শুরু করার আগে নারী-পুরুষ এক আদিম একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিল। মূলত তারা একজন পরম উপাস্যের (Supreme Deity) অস্তিত্ব স্বীকার করত, যিনি জগৎ সৃষ্টি করেছেন এবং সুদূরে অবস্থান করে মানুষের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকেন। এরকম পরম ঈশ্বরে (High God) (অনেক সময় স্কাই গড’ আখ্যায়িত করা হয়, যেহেতু তিনি স্বর্গের সঙ্গে সম্পর্কিত) বিশ্বাস এখনও আফ্রিকার বহু আদি গোত্রের ধর্মীয় জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য রয়ে গেছে। তারা প্রার্থনার মাধ্যমে ঈশ্বরের নৈকট্য অন্বেষণ করে; বিশ্বাস করে যে তিনি তাদের ওপর নজর রাখছেন এবং পাপের শাস্তি দেবেন। কিন্তু বিস্ময়করভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনে তিনি অনুপস্থিত: তাঁর কোনও বিশেষ কাল্ট নেই এবং কোনও প্রতিমার মাধ্যমেও উপস্থাপিত হননি। গোত্রের সদস্যরা বলে থাকে যে, তিনি প্রকাশের অতীত, মানুষের এই জগৎ দিয়ে তাঁকে কলঙ্কিত করা যায় না। কেউ কেউ বলে থাকে তিনি ‘চলে গেছেন।’ নৃতাত্ত্বিকগণ মত প্রকাশ করেছেন যে, এই ঈশ্বর দূরবর্তী ও মহিমান্বিত হয়ে ওঠায় কার্যতঃ তিনি নিম্নতর আত্মা ও অধিকতর বোধগম্য দেবতা দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছেন। স্মিডটের মতবাদও একই কথা বলছে। প্রাচীনকালে পরম ঈশ্বর পৌত্তলিকদের দেবনিচয়ের অধিকতর আকর্ষণীয় দেবতা দিয়ে। প্রতিস্থাপিত হয়েছেন। সুতরাং, আদিতে ঈশ্বর একজনই ছিলেন। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে জীবনের রহস্য ও যন্ত্রণা ব্যাখ্যা করার জন্যে মানব সৃষ্ট প্রাচীন ধারণাসমূহের মধ্যে একেশ্বরবাদ ছিল অন্যতম। এখানে এমন একজন। আরাধ্য বা উপাস্য কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন তারও একটা আভাস মেলে ।
এ ধারণার সত্য-মিথ্যা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে বহু তত্ত্ব রয়েছে। তবে মনে হয় দেবতার সৃষ্টি এমন একটা ব্যাপার মানবজাতি যা সব সময় করে এসেছে। যখন কোনও একটা ধর্মীয় আদর্শ তাদের জন্যে অকার্যকর হয়ে পড়ে, স্রেফ তার স্থানে অন্য এক ধারণা বসিয়ে দেওয়া হয়। এসব ধারণা স্কাই গডের মতো কোনওরকম হট্টগোল ছাড়াই হারিয়ে যায়। আমাদের বর্তমান কালেও অনেকে বলবেন ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমদের উপাস্য ঈশ্বরও স্কাই গডের মতো দূরবর্তী হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ প্রকৃতই এমনও দাবি করেছেন যে, তিনি পরলোকগমন করেছেন। বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের মানুষের জীবন যাপনের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান হারে তার অপসারণ ঘটছে। তাঁরা আমাদের চেতনায় ঈশ্বর আকৃতির গহ্বরের কথা বলেন, যেখানে তার অবস্থান ছিল; কারণ কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাকে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও আমাদের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি এবং মানুষের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মতবাদসমূহের তিনি অন্যতম। আমরা কী হারাতে বসেছি বোঝার জন্যে-মানে, যদি সত্যি তিনি অপসৃয়মান হয়ে থাকেন-আমাদের দেখতে হবে এই ঈশ্বরের উপাসনা শুরু করার সময় মানুষ কী করছিল। কী তার অর্থ ছিল এবং কীভাবে তার উৎপত্তি ঘটেছিল। এ জন্যে আমাদের ফিরে যেতে হবে মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন কালে, যেখানে ১৪,০০০ বছর আগে আমাদের ঈশ্বরের ধারণা ধীরে ধীরে আবির্ভূত হয়েছিল।
আজকের দিনে ধর্মকে অপ্রাসঙ্গিক মনে হওয়ার অন্যতম কারণ আমাদের অনেকেই এখন আর অদৃশ্য বিষয়াদি দিয়ে পরিবেষ্টিত থাকার অনুভূতি লালন করি না। আমাদের বিজ্ঞান ভিত্তিক সংস্কৃতি আমাদেরকে চোখের সামনের ভৌত ও বস্তুজগতের দিকে মনোযোগ দিতে শেখায়। জগৎ দেখার এই পদ্ধতি ব্যাপক ফল অর্জন করেছে। অবশ্য এর একটা পরিণাম হচ্ছে আমরা আমাদের ‘আধ্যাত্মিক’ বা ‘পবিত্র’ অনুভূতি হেঁটে ফেলেছি যা অধিকতর প্রথাগত সমাজে মানুষের জীবনের প্রত্যেকটা স্তরে প্রভাব বিস্তার করে থাকে, এক কালে যা মানুষের জগতকে বোঝার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল। সাউথ-সীর দ্বীপমালার অধিবাসীরা এই রহস্যময় শক্তিকে মানা (mana) আখ্যায়িত করে, অন্যরা একে এক ধরনের উপস্থিতি বা সত্তা হিসাবে অনুভব করে-কখনও কখনও এটা তেজস্ক্রিয়তা বা বিদ্যুৎ প্রবাহের মতো এক ধরনের নৈর্ব্যক্তিক ক্ষমতা হিসাবে অনুভূত হয়। গোত্রীয় প্রধান, গাছপালা, পাথর ও জীব জানোয়ারে এর আবাস বলে বিশ্বাস করা হতো। লাতিনরা পবিত্র মনে নুমিনা আত্মার অনুভূতি লাভ করে। আরবরা মনে করত গোটা পরিবেশ জিন-এ পরিপূর্ণ। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ এই বাস্তবতার সংস্পর্শে আসতে চেয়েছে, এগুলোকে কাজে লাগাতে চেয়েছে, কিন্তু আবার একে স্রেফ শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছে তারা। অদৃশ্য শক্তিসমূহকে যখন তারা ব্যক্তি সত্তায় পরিণত করে তাদের বাতাস, সূর্য, সাগর ও তারার সঙ্গে সম্পর্কিত কিন্তু মানবীয় চরিত্রের অধিকারী দেবতা বিবেচনা করতে শুরু করে, তখন তারা অদৃশ্যের সঙ্গে নিজেদের ও চারপাশের জগতের একাত্মতার সাধনাই প্রকাশ করেছিল।
ধর্মের ইতিহাসবিদ জার্মান রুডলফ অটো ১৯১৭ সালে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ দ্য আইডিয়া অভ দ্য হোলি প্রকাশ করেন। তাঁর বিশ্বাস নুমিনাসের এই অনুভূতিই ধর্মের মৌল বিষয়। এটা পৃথিবীর উৎপত্তি বা নৈতিক আচরণের একটা ভিত্তি খোঁজার ইচ্ছার অগ্রবর্তী। বিভিন্নভাবে মানুষ মুমিনাস শক্তি অনুভব করেছে-কখনও এটা বুনো ঘোর লাগা উত্তেজনা সৃষ্টি করে, কখনও এনে দিয়েছে গভীর প্রশান্তি; কখনও কখনও মানুষ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সহজাত রহস্যময় শক্তির উপস্থিতিতে ভয়, বিস্ময় ও তুচ্ছতার অনুভূতি লাভ করেছে। মানুষ যখন তার মিথসমূহ সৃষ্টি ও দেবতাদের উপাসনা শুরু করে তখন প্রাকৃতিক ঘটনাপ্রবাহের নিখুঁত ব্যাখ্যা আকাঙ্ক্ষা করেনি। রূপায়িত কাহিনী, গুহাচিত্র ও খোদাইচিত্রগুলো ছিল তাদের বিস্ময় ও ভাবনা প্রকাশের প্রয়াসের পাশাপাশি এই ভিন্নতর রহস্যময় শক্তিকে নিজেদের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত করার প্রয়াস। প্রকৃতপক্ষেই বর্তমানকালের কবি, শিল্পী ও সঙ্গীত শিল্পীরাও একই রকম আকাক্ষায় তাড়িত হন। উদাহরণ স্বরূপ, প্যালিওলিথিক যুগে কৃষি কাজের বিকাশ ঘটার সময় মাদার গডেসের উপর বিশ্বাস এই অনুভূতির প্রকাশ করেছে যে, মানুষের জীবনকে বদলে দেওয়া উর্বরতার পবিত্র মূল্য রয়েছে। শিল্পীরা তাঁকে নগ্ন অন্তঃসত্ত্বা নারী হিসাবে এঁকেছেন। সমগ্র ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতে নৃতাত্ত্বিকগণ এর আবিষ্কার করেছেন। বহু শত বছর মহান মাতা (Great Mother) কল্পনাযোগ্যভাবেই গুরুত্বপূর্ণ রয়ে গেছেন। প্রাচীন স্কাই গডের মতো পরবর্তীকালে দেবীদের মধ্যে হারিয়ে যান তিনি, অপরাপর উপাস্যের পাশে স্থান করে নেন। অত্যন্ত শক্তিশালী দেবী ছিলেন তিনি, স্কাই গডের চেয়ে শক্তিশালী তো বটেই–যিনি অস্পষ্ট সত্তা রয়ে গিয়েছিলেন। প্রাচীন সুমেরিয়ায় ইনানা, বাবিলনে ইশতার এবং কানানে আনাত নামে ডাকা হতো তাঁকে; মিশরে আইসিস আর গ্রিসে আফ্রোদাইত। এইসব সংস্কৃতিতে মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনে তার ভূমিকা বর্ণনা করার জন্যে আশ্চর্যজনকভাবে একই ধরনের গল্প-গাথা সৃষ্টি হয়েছিল । এইসব মিথ আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করার কোনও পরিকল্পনা ছিল না, বরং অন্য যে কোনওভাবে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে জটিল ও দূরবর্তী এক সত্তাকে বর্ণনার রূপকাশ্রিত প্রয়াস ছিল এগুলো । এই নাটকীয় ও স্মৃতি জাগানিয়া। দেব-দেবীর গল্পগুলো মানুষকে তার চারপাশের অদৃশ্য অথচ ক্ষমতাবান শক্তিসমূহকে অনুভব করার ক্ষমতাকে সংগঠিত করায় সাহায্য করেছে।