বিষয়বস্তু যেহেতু ব্যাপক, আমি তাই ইচ্ছাকৃতভাবেই ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমদের উপাস্য একক ঈশ্বরে নিজেকে সীমিত রেখেছি, যদিও ক্ষেত্র বিশেষে পৌত্তলিক, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধারণাসমূহও আলোচনা করেছি যাতে পরম সত্তা সম্পর্কিত একেশ্বরবা যুক্তিসমূহ আরও স্পষ্ট করা যায়। বিভিন্ন ধর্মে একেবারে স্বাধীনভাবে গড়ে ওঠা ঈশ্বরের ধারণা আশ্চর্যরকমভাবে সমরূপ বলে মনে হয়। ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের উপসংহার যাই হোক না কেন, এই ধারণার ইতিবৃত্ত আমাদেরকে অবশাই মানুষের মনোজগত এবং আমাদের আকাক্সক্ষার প্রকৃতি সম্পর্কে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেবে। অধিকাংশ পাশ্চাত্য সমাজের সেকুলার ধারা সত্ত্বেও ঈশ্বরের ধারণা আজও লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে চলেছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, শতকরা নিরানব্বই ভাগ আমেরিকান জানিয়েছে তারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে: প্রশ্ন হচ্ছে অসংখ্য ঈশ্বরের মাঝে কোনজনের প্রভুত্ব স্বীকার করে তারা?
ধর্মতত্ত্ব প্রায়শঃই বিমূর্ত ও একঘেয়ে মনে হয়, কিন্তু ঈশ্বরের ইতিহাস আবেগময় এবং প্রবলভাবে টানে। পরম বা চরম সত্তার অন্যান্য ধারণার বিপরীতে মূলত যন্ত্রণাদায়ক সংগ্রাম ও চাপের মধ্য দিয়ে একে লালন করা হয়েছে। ইসরায়েলের পয়গম্বরগণ শরীরের অন্ধিসন্ধি মুচড়ে দেওয়া দৈহিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে তাঁদের ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেছেন যা তাঁদের ক্রোধ ও আনন্দে পরিপূর্ণ করে দিয়েছে। যে সত্তাকে তারা ঈশ্বর হিসাবে আখ্যায়িত করে একেশ্বরবাদীরা এক চরম অবস্থায় তার অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকে। আমরা পর্বতচূড়া, অন্ধকার, নিঃসঙ্গতা, সিফিকশন ও ত্রাসের কথা পাঠ করব। ঈশ্বর সংক্রান্ত পাশ্চাত্য অভিজ্ঞতা যেন বিশেষভাবে পীড়াদায়ক। এই সহজাত যাতনার কারণ কী? অন্য একেশ্বরবাদীরা আলো ও আকৃতির পরিবর্তনের কথা বলেছে। যে সত্তার অভিজ্ঞতা তারা লাভ করে তার বিবরণ দিতে গিয়ে অর্থডক্স ধর্মতত্ত্বের সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া সাহসিকতাপূর্ণ কল্পনার আশ্রয় নেয়। সাম্প্রতিককালে মিথলজি নিয়ে নতুন করে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। এক ধর্মীয় সত্যের অধিকতর অভিব্যক্তির এক ব্যাপক আকাক্ষার প্রকাশ হিসাবে দেখা যেতে পারে। প্রয়াত আমেরিকান পণ্ডিত জোসেফ ক্যাম্পবেলের রচনাবলী আজকাল দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মানুষের চিরকালীন মিথলজি নিয়ে গবেষণা করেছেন তিনি, প্রথাগত সমাজে এখনও প্রচলিত কিংবদন্তীসমূহের সঙ্গে সেগুলোর যোগসূত্র আবিষ্কার করেছেন। প্রায়শঃ ধারণা করা হয় যে, তিনটি ঈশ্বর-ধর্ম বুঝি মিথলজি ও কাব্যিক প্রতীকধর্মীতা মুক্ত। কিন্তু একেশ্বরবাদীরা আদিতে তাদের পৌত্তলিক প্রতিবেশীদের মিথ প্রত্যাখ্যান করলেও পরবর্তীকালে সেগুলো আবার তাদের অজান্তেই তাদের মাঝে ফিরে এসেছে। যেমন, অতিন্দ্রীয়বাদীরা ঈশ্বরকে নারী রূপে প্রত্যক্ষ করেছে। অন্যরা শ্রদ্ধার সঙ্গে ঈশ্বরের লিঙ্গ সম্পর্কে আলোচনা করেছে এবং স্বর্গীয় সত্রায় নারীসুলভ উপাদান যোগ করেছে।
এটা আমাকে এক কঠিন পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। কারণ এই ঈশ্বরের শুরু হয়েছিল পুরুষ দেবতা হিসাবে, একেশ্বরবাদীরা সাধারণত তাকে ‘পুরুষবাচক সে’ হিসাবে উল্লেখ করে থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নারীবাদীরা বোধগম্যভাবেই এর প্রতি আপত্তি উত্থাপন করেছে। আমি যেহেতু ঈশ্বরকে ‘পুরুষবাচক সে’ হিসাবে বিবেচনাকারী মানুষের চিন্তা, ভাবনা ও দর্শন নিয়ে আলোচনা করব, তাই যদিও এটা বলাই যথোপযুক্ত শব্দ হতো, তবু আমি প্রথাগত পুরুষবাচক সর্বনামই ব্যবহার করব। এটা উল্লেখ করা বোধ হয় সমীচিন হবে যে, বিশেষ করে ইংরেজিতে ঈশ্বরের আলোচনায় পুরুষবাচক সম্বোধন ব্যবহার কষ্টকর। অবশ্য হি, আরবী ও ফরাসি ভাষায় ব্যাকরণগত লিঙ্গ ধর্মীয় আলোচনায় লিঙ্গিয় পাল্টা যুক্তি ও ডায়ালেকটিক এর সুযোগ সৃষ্টি করে যা এক ধরনের ভারসাম্য যোগায়, ইংরেজিতে যার অভাব রয়েছে। এভাবে আরবী আল্লাই (ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ট নাম) ব্যাকরণগতভাবে পুরুষবাচক, কিন্তু ঈশ্বরের অলৌকিক এবং দুৰ্জ্জেয় সত্তাবোধক শব্দটি—’আল-ধাত’–নারীবাচক।
ঈশ্বর সম্পর্কিত সকল আলোচনা অসম্ভব সমস্যায় আবর্তিত। কিন্তু একেশ্বরবাদীরা ভাষার ব্যাপারে অত্যন্ত ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করার পাশাপাশি একই সময়ে দুর্জ্ঞেয় সত্তার প্রকাশে ভাষার ক্ষমতাহীনতাও মেনে নেয়। ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমদের ঈশ্বর এমন একজন যিনি-এক অর্থে-কথা বলেন। তিনটি ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রেই তাঁর বাণী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঈশ্বরের বাণী আমাদের সংস্কৃতির ইতিহাস নির্মাণ করেছে। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে বর্তমানে ‘ঈশ্বর’ শব্দটি আমাদের জন্যে কোনও অর্থ বহন করে কিনা।
টীকা: আমি যেহেতু ইহুদি, মুসলিম ও ক্রিশ্চানদের দৃষ্টিকোণ থেকে ঈশ্বরের ইতিহাস পর্যালোচনা করছি, সেহেতু পশ্চিমে সাধারণভাবে ব্যবহৃত ‘খৃস্টপূর্ব’ এবং ‘খৃস্টাব্দ’ শব্দবন্ধ দুটি যথার্থ নয়। সেজন্যে আমি বিকল্প-বিসিই (Before the Common Era) এবং সিই (Common Era)-এর আশ্রয় নিয়েছি।