এই বইটি সময় ও পরিবর্তনের অতীত স্বয়ং ঈশ্বরের বর্ণনাতীত বাস্তবতার ইতিহাস হবে না, বরং আব্রাহামের কাল থেকে আজকের দিন পর্যন্ত নারী ও পুরুষ যেভাবে তাঁকে কল্পনা করেছে, এটা তারই ইতিহাস। ঈশ্বর সম্পর্কে মানুষের ধারণার একটি ইতিহাস আছে, কিন্তু কালের বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে একে ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীর কাছে তা বরাবরই পরিবর্তিত অর্থ বহন করেছে। কোনও এক প্রজন্মে এক দল মানুষের সৃষ্ট ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণা অন্য এক দল মানুষের কাছে অর্থহীন হয়ে দাঁড়াতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, ‘আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি’ কথাটার বাস্তব কোনও অর্থ নেই, কিন্তু যখন কোনও নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মুখে বিশেষ প্রেক্ষাপটে উচ্চারিত হয় তখনই অন্য যে কোনও বাক্য বা কথার মতো ঐ প্রেক্ষাপটে তা অর্থ প্রকাশ করে থাকে। ফলে ‘ঈশ্বর’ শব্দের মাঝে কোনও একক অন্তর্নিহিত অপরিবর্তনীয় ধারণা নেই, বরং শব্দটি ব্যাপক অর্থ বহন করে যেগুলো আবার পরস্পর বিরোধী এবং এমনকি একটা অপরটিকে বাতিলও করে। ঈশ্বরের ধারণায় এই পরিবর্তনশীলতা না থাকলে অন্যতম মহান মানবীয় ধারণা হবার জন্যে তা টিকে থাকত না। যখনই ঈশ্বর সম্পর্কিত একটি ধারণা অর্থ হারিয়েছে বা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে, নীরবে সেটাকে বর্জন করে এক নতুন ধারণাকে সেখানে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। একজন মৌলবাদী একথা প্রত্যাখ্যান করবে, কেননা মৌলবাদ ইতিহাস। বিরোধী: এটা বিশ্বাস করে যে আব্রাহাম, মোজেস ও পরবর্তীকালের পয়গম্বরগণ আজকের দিনের মানুষের মতোই তাদের ঈশ্বরের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। কিন্তু আমাদের তিনটি ধর্মের দিকে তাকালে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে ঈশ্বরের কোনও বস্তুনিষ্ঠ ধারণা নেই, প্রত্যেক প্রজন্মকেই তার জন্যে কার্যকর ঈশ্বরের ইমেজ নির্মাণ করে নিতে হয়। নাস্তিক্যবাদের ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য। ‘আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না’ কথাটা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত অর্থ প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন সময়ে ‘নাস্তিক’ হিসাবে আখ্যায়িত ব্যক্তিরা এলাকার বিশেষ একটি ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছে। আজকের নাস্তিকদের প্রত্যাখ্যাত ঈশ্বরই কি প্যাট্রিয়ার্কদের ঈশ্বর, পয়গম্বরদের ঈশ্বর, দার্শনিকদের ঈশ্বর, অতিন্দ্রীয়বাদীদের ঈশ্বর কিংবা অষ্টাদশ শতকের ডেইস্টদের ঈশ্বর? এইসব উপাস্যই ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমগণ কর্তৃক তাদের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বাইবেল এবং কোরানের ঈশ্বর হিসাবে উপাসিত হয়েছেন। আমরা দেখব, তারা একে অপরজন থেকে একেবারে আলাদা। নাস্তিক্যবাদ প্রায়শঃ পরিবর্তনশীল একটা অবস্থা ছিল: এভাবে ইহুদি, ক্রিস্টান ও মুসলিমরা তাদের সমসাময়িক পৌত্তলিক প্রতিপক্ষ কর্তৃক নাস্তিক আখ্যায়িত হয়েছে, কেননা তারা অলৌকিকত্ব ও পরম সত্তা সম্পর্ক এক বিপ্লবাত্মক ধারণা অবলম্বন করেছিল। আধুনিক নাস্তিক্যবাদ কি একইভাবে আমাদের সময়ের সমস্যাদির প্রেক্ষিতে অপর্যাপ্ত ঈশ্বরের প্রতি আনাস্থা?
অন্য জগতের কথা বললেও ধর্ম দারুণভাবে বাস্তবসম্মত। আমরা দেখব যে, ঈশ্বর সম্পর্কিত কোনও বিশেষ ধারণা যৌক্তিক বা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণে মাথাযথ হওয়ার চেয়ে বরং এর কার্যকারিতাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এর কার্যকারিতা বাইত হলেই তা বদলে যাবে-কখনও কখনও যা তীব্রভাবে ভিন্নতর। আমাদের পূর্ববর্তী একেশ্বরবাদীরা এতে এতটুকু বিচলিত হয়নি, কেননা তারা স্পষ্ট করেই জানত যে, ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের ধারণা স্থির বা অপরিবর্তনীয় নয়, বরং সাময়িক। এগুলো ছিল পুরোপুরি মানুষের সৃষ্টি-অন্য কিছু হতে পারে না-বরং এগুলো যে বর্ণনাতীত সত্তাকে প্রতীকায়িত করে। তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কেউ কেউ এই অত্যাবশ্যকীয় পার্থক্যের ওপর। গুরুত্ব আরোপ করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত উদ্ধত পন্থার উদ্ভব ঘটিয়েছে। মধ্যযুগীয় জনৈক সাধু এতদূর পর্যন্ত বলেছেন যে, ভুলক্রমে এই পরম সত্তা ঈশ্বর বাইবেলে উল্লেখিতই হননি। সমগ্র ইতিহাস জুড়ে নারী-পুরুষ জাগতিক। বিশ্বের অতীত আত্মার একটা মাত্রা যেন প্রত্যক্ষ করেছে। প্রকৃতপক্ষে, এটা। মানব মনের এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য যে, তারা বোধের অতীত এই রকম একটা ধারণাকে ধারণ করতে পারে। আমরা একে যেভাবেই ব্যাখা করতে চাই না কেন মানুষের দুয়ের এই অভিজ্ঞতা জীবনেরই বাস্তবতা রয়ে গেছে। সবাই একে অলৌকিক বলে মেনে নেবে তা নয়। আমরা যেমন দেখব, বৌদ্ধরা তাদের দর্শন ও অন্তর্দৃষ্টি অতিপ্রাকৃত উৎস হতে গৃহীত বলে স্বীকার করে না; তারা একে মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক হিসাবে দেখে। অবশ্য প্রধান সকল ধর্ম স্বীকার করবে যে, এই দুর্জ্ঞেয়কে স্বাভাবিক ধারণাগত ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব। একেশ্বরবাদীরা এই দুয়েকে ‘ঈশ্বর’ আখ্যা দিয়েছে, কিন্তু এর চারপাশে জরুরী কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, ইহুদিদের বেলায় ঈশ্বরের পবিত্র নাম উচ্চারণ নিষিদ্ধ, মুসলিমরা অলৌকিককে দর্শনীয় প্রতিমায় উপস্থাপিত করতে পারবে না। এই বিধান মনে করিয়ে দেয়, যে সত্তাকে আমরা ‘ঈশ্বর’ আখ্যায়িত করি তা সকল মানবীয় অভিব্যক্তির অতীত।
এটা প্রচলিত ধারার ইতিহাস হবে না, যেহেতু ঈশ্বরের ধারণা কোনও বিশেষ কালে সৃষ্টি হয়ে একরৈখিকভাবে চূড়ান্ত রূপ লাভ করেনি। বৈজ্ঞানিক ধারণা ওভাবে অগ্রসর হয়, কিন্তু শিল্পকলা বা ধর্মের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে না। প্রেমের কবিতায় যেমন অল্প সংখ্যক থিম রয়েছে ঠিক সেরকমই মানুষ ঈশ্বর সম্পর্কে বারবার একই কথার পুনরাবৃত্তি করে এসেছে। প্রকৃতপক্ষে, আমরা ঈশ্বর সম্পর্কে ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিম বিশ্বাসে বিস্ময়কর মিল লক্ষ করব। যদিও ইহুদি ও মুসলিমরা ক্রিশ্চানদের ট্রিনিটি ও ইনকারনেশনের ধারণাকে প্রায় ব্লাসফেমাস বিবেচনা করে, কিন্তু এইসব বিতর্কিত ধর্মতত্ত্বের নিজস্ব ধরনও সৃষ্টি করেছে তারা। এইসব সর্বজনীন ধারণার প্রত্যেকটি একটি অপরটির চেয়ে সামান্য ভিন্নতার অধিকারী, যা ঈশ্বরের অভিব্যক্তি প্রকাশের ক্ষেত্রে মানুষের সৃজনশীলতা ও মেধার পরিচয় প্রকাশ করে।