এরপর দুঃখের সঙ্গে ধর্মীয় জীবন ত্যাগ করি আমি; ব্যর্থতা ও অপূর্ণতার ভার হতে মুক্ত হবার পর ঈশ্বরে আমার বিশ্বাসও নীরবে বিদায় নিয়েছে বলে মনে হয়েছে। আমার জীবনে কখনও জোরাল প্রভাব রাখতে পারেননি তিনি, যদিও তাকে দিয়ে সেটা করানোর যথাসাধ্য প্রয়াস ছিল আমার। এখন তাঁর ব্যাপারে আর নিজেকে অপরাধী বা উদ্বিগ্ন মনে না হওয়ায়, এতই দূরে সরে গেলেন যে অস্তিত্ব নেইই বলা চলে। অবশ্য ধর্মীয় ব্যাপারে আমার আগ্রহ বা কৌতূহল অব্যাহত রয়ে গেছে। ক্রিশ্চানিটির গোড়ার দিকের ইতিহাস ও ধর্মীয় অভিজ্ঞতার প্রকৃতির ওপর বেশ কয়েকটা টেলিভিশন অনুষ্ঠান করেছি আমি। ধর্মীয় ইতিহাস সম্পর্কে যতই জেনেছি ততই আমার পুরোনো কিছু সন্দেহ যৌক্তিক প্রতীয়মান হতে শুরু করেছে। ছোটবেলায় বিনা প্রশ্নে যেসব মতবাদ মেনে নিয়েছিলাম সেগুলো আসলেই দীর্ঘ সময় জুড়ে মানুষেরই গড়ে তোলা। বিজ্ঞান যেন স্রষ্টা ঈশ্বরকে বাতিল করে দিয়েছে; বাইবেলিয় পণ্ডিতগণ প্রমাণ করেছেন জেসাস কখনও নিজেকে স্বর্গীয় সত্তা দাবি করেননি। একজন এপিলেপটিক হিসাবে মামার কিছু কিছু দৃষ্টিবিভ্রমের অভিজ্ঞতা ছিল সেগুলো স্রেফ স্নায়ুবিক দুর্বলতার ফল বলে জানতাম আমি: তবে কি সাধু-সন্ন্যাসীদের দিব্যদৃষ্টি ও পরমানন্দের অনুভূতিও কেবল তাদের মানসিক আলোড়নের প্রকাশ? ঈশ্বর যেন ক্রমবর্ধমান হারে স্থানচ্যুত হয়ে গেছেন বলে মনে হয়েছে, মানবজাতি যাকে অতিক্রম করে এসেছে।
নান হিসাবে আমার দীর্ঘ কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও ঈশ্বর সম্পর্কে নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে অস্বাভাবিক মনে করি না। ঈশ্বর সম্পর্কে আমার ধারণাগুলো গড়ে উঠেছিল ছোটবেলায়, অন্যান্য বিষয়ে আমার ক্রমবর্ধমান জ্ঞানের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি। আমি ফাদার ক্রিসমাসের ছোটবেলার সহজ ধারণাকে পরিমার্জনা করেছি, মানুষের দ্বিধা সংশয় সম্পর্কে আরও পরিপূর্ণ উপলব্ধি অর্জন করতে পেরেছি। কিন্ডারগার্টেনে যেটা সম্ভব ছিল না। তা সত্ত্বেও ঈশ্বর সম্পর্কে আমার পুরোনো ভ্রান্ত ধারণা পরিবর্তিত বা বিকশিত হতে পারেনি। আমার মতো বিচিত্র ধর্মীয় পটভূমি নেই যাদের তারাও হয়তো আবিষ্কার করবেন যে, ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের ধারণা ছোটবেলায় গড়ে ওঠা। সেদিনগুলোর পরে আমরা ছোটবেলার সবকিছু ফেলে এসেছি ও আমাদের শিশু বয়সের স্রষ্টাকেও বাদ দিয়েছি।
কিন্তু তারপর ধর্মের ইতিহাস নিয়ে আমার গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে, মানুষ আসলে আধ্যাত্মিক প্রাণী। প্রকৃতপক্ষেই হোমো সেপিয়েরা আসলে হোমো রিলিজিয়াস বলে তর্ক করার যথেষ্ট অবকাশও রয়েছে। নারী ও পুরুষ মোটামুটিভাবে মানুষ হয়ে ওঠার পর পরই দেব-দেবীর উপাসনা শুরু করেছিল; শিল্পকলার মতোই একই সময়ে তারা ধর্মকে সৃষ্টি করেছে। এটা যে কেবল ক্ষমতাশালী শক্তিকে প্রসন্ন করার জন্য ছিল তা নয়; এইসব আদি বিশ্বাস এই সুন্দর অথচ ভীতি জাগানো জগৎ নিয়ে মানুষের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। শরীর যে দুঃখ কষ্টের তা সত্ত্বেও জীবনের একটা অর্থ অনুসন্ধানে শিল্পের মতো ধর্মও একটি প্রয়াস। অন্য যে কোনও মানবীয় কর্মকাণ্ডের মতো ধর্মকেও অপব্যবহার করা যায়, আর আমরা যেন সেটাই সব সময় করে এসেছি। কুচক্রী রাজরাজরা ও পুরোহিতগণ আদিম সেকুলার স্বভাবের ওপর এটা চাপিয়ে দেননি, বরং এটা মানুষেরই স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের বর্তমান সেকুলারিজম একেবারেই নতুন এক নিরীক্ষা, মানব ইতিহাসে যার নজীর নেই। এর পরিণতি দেখার জন্যে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে। এ কথা সত্য যে, আমাদের পশ্চিমা উদার মানবতাবাদ শিল্পকলা বা কবিতার উপলব্ধির মতো আপনাআপনি আমাদের কাছে আসেনি, এর পরিচর্যা করতে হয়েছে। খোদ মানবতাবাদ ঈশ্বরবিহীন ধর্ম-সকল ধর্ম যে স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস রাখে তা অবশ্য নয়। আমাদের নৈতিক সেকুলার আদর্শের মনকে পরিচালিত করার নিজস্ব নিয়ম-কানুন রয়েছে যা মানুষকে মানব জীবনের পরম অর্থ সন্ধানে সাহায্য করে। এক সময় যা প্রথাগত ধর্মগুলোর কাজ ছিল।
তিনটি পরস্পর সম্পর্কিত একেশ্বরবাদী ধর্ম ইহুদিবাদ, খৃস্টধর্ম ও ইসলামে ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণা এবং অভিজ্ঞতার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা শুরু করার সময় আমি ভেবেছিলাম ঈশ্বরকে কেবল মানুষের প্রয়োজন ও ইচ্ছার সাধারণ এক প্রকাশ হিসাবে আবিষ্কার করব। আমার ধারণা ছিল যে তিনি সমাজ বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে এর আতঙ্ক ও আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরেছেন। আমার অনুমান একেবারে অমূলক প্রতীয়মান হয়নি, তবে আমার কিছু কিছু আবিষ্কারে দারুণ বিস্মিত হয়েছি। আমার মনে হয়েছে তিরিশ বছর আগে যখন ধর্মীয় জীবন শুরু করতে যাচ্ছিলাম তখন এসব জানতে পারলে তিনটি একেশ্বরবাদী বিশ্বাসের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মুখে মহাশূন্য থেকে ঈশ্বরের অবতরণের অপেক্ষায় না থেকে নিজের জন্যে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে একটা ধারণা সৃষ্টি করে নেওয়া উচিত–একথা শোনার তীব্র উদ্বেগ থেকে রক্ষা পেতাম। অন্যান্য রাবাই, যাজক ও সুফীগণ আমাকে ঈশ্বরকে কোনও অর্থে ‘মহাশূন্যের বাস্তবতা’ মনে করার জন্যে তিরস্কার করতেন। আমাকে যৌক্তিক চিন্তার সাধারণ প্রক্রিয়ায় আবিষ্কৃত হওয়ার মতো বাস্তব বিষয় হিসাবে তার অভিজ্ঞতা লাভের প্রত্যাশা না করতে সতর্ক করে দিতেন তাঁরা। আমাকে বলতেন, এক গুরুত্বপূর্ণ অর্থে ঈশ্বর সৃজনশীল কল্পনার সৃষ্টি, আমার কাছে অনুপ্রেরণাদায়ী মনে হওয়া কবিতা ও সঙ্গীতের মতো। অত্যন্ত সম্মানিত কিছু একেশ্বরবাদী হয়তো শান্ত ও দৃঢ় কণ্ঠে আমাকে বলতেন, প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই-এবং তারপরেও ‘তিনি’ এই বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা।