ক্ষমতায়নের এই নতুন বোধের বিনিময়ে মূল্য দিতে হয়েছিল। মানবীয় উপলব্ধির বিচারে স্কাই গডকে অনেক বেশি দূরবর্তী মনে হয়েছিল। মারদুক, বাআল এবং মাতৃদেবী (Mother Goddesses)রা মানবজাতির অনেক কাছাকাছি ছিলেন, কিন্তু ইয়াহ্ওয়েহ্ আবার মানুষ ও স্বর্গের মাঝে বিরাট দূরত্ব ফিরিয়ে এনেছিলেন। সিনাই পর্বতের কাহিনীতে এ বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠেছে। পর্বতের কাছে পৌঁছার পর জনতাকে পোশাক পবিত্র করে দূরে অবস্থান করার নির্দেশ দেওয়া হয়। মোজেস ইসরায়েলিদের সতর্ক করতে বাধ্য হয়েছেন: ‘পাহাড়ের কাছাকাছি যাবে না বা ওটার পাদদেশ স্পর্শ করবে না। যে পাহাড়ের গায়ে হাত দেবে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। জনতা পাহাড় থেকে দূরে অবস্থান করেছে আর ইয়াহ্ওয়েহ্ আগুন ও মেঘের মাঝে অবতীর্ণ হয়েছেন:
পরে তৃতীয় দিন প্রভাত হইলে মেঘগর্জন ও বিদ্যুৎ এবং পৰ্ব্বতের উপরে নিবিড় মেঘ হইল আর অতিশয় উচ্চরবে তূরীধ্বনি হইতে লাগিল; তাহাতে শিবিরস্থ সমস্ত লোক কাঁপিতে লাগিল। পরে মোজেস ঈশ্বরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিবার জন্যে লোকদিগকে শিবির হইতে বাহির করিলেন। আর তাহারা পৰ্ব্বতের তলে দণ্ডায়মান হইল। তখন সমস্ত সিনাই পৰ্ব্বত ধূমময় ছিল; কেননা ইয়াহ্ওয়েহ্ অগ্নিসহ তাহার উপরে নামিয়া আসিলেন আর ভাটীর ধূমের ন্যায় তাহা হইতে ধূম উঠিতে লাগিল এবং সমস্ত পর্বত অতিশয় কাঁপিতে লাগিল।[২০]
মোজেস একাকী পাহাড়চূড়ায় উঠলেন এবং ল (Law) উৎকীর্ণ পাথরখণ্ডসমূহ গ্রহণ করলেন। পৌত্তলিক দর্শনের অনুরূপ প্রকৃতি হতে আহরণের বদলে শৃঙ্খলা, সাম্য ও ন্যায়বিচারের মূল নীতিমালাসমূহ অর্থাৎ আইন এবার মহাকাশ হতে অবতীর্ণ করা হলো। ইতিহাসের ঈশ্বর জাগতিক বিশ্বের অধিকতর মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেন, তাঁর লীলাক্ষেত্র কিন্তু আবার এ থেকে গভীরভাবে আলাদা থাকার প্রবণতাও রয়েছে।
বিসিই পঞ্চম শতাব্দীতে সম্পাদিত এক্সোডাসের চূড়ান্ত টেক্সট-এ সিনাই পর্বতে ঈশ্বর মোজেসের সঙ্গে একটা চুক্তিতে (covennant) উপনীত হওয়ার কথা বলা হয়েছে (এ ঘটনাটি ১২০০ সাল নাগাদ সংঘটিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। এ বিষয়ে পণ্ডিতদের মাঝে বিতর্ক আছে: কোনও কোনও সমালোচক বিশ্বাস করেন যে, বিসিই সপ্তম শতাব্দীর আগে এই চুক্তি ইসরায়ের্লে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। কিন্তু সময় যাই হোক, চুক্তির ধারণা আমাদের জানায় যে, ইসরায়েলিরা তখন একেশ্বরবাদী হয়ে ওঠেনি, কেননা এটা কেবল বহু ঈশ্বরের পটভূমিতেই খাপ খায়। ইসরায়েলিরা এটা বিশ্বাস করত না যে সিনাইয়ের ঈশ্বর ইয়াহ্ওয়েহ্ই একমাত্র ঈশ্বর, তবে তারা অঙ্গীকার করেছিল, অন্য সব দেবতাকে অগ্রাহ্য করে তারা কেবল ইয়াহ্ওয়েহ্রই উপাসনা করবে। গোটা পেন্টাটিউকে একটা একেশ্বরবাদী ঘোষণা বা বাক্য খুঁজে বের করাও খুব কঠিন। এমনকি সিনাই পর্বতে হস্তান্ত। রিত টেন কমান্ডমেন্টসও অন্য দেবতাদের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছে: ‘আমার সামনে তোমাদের জন্যে আর কোনও অচেনা দেবতা থাকবে না।’[২১] মাত্র একজন উপাস্যের উপাসনা করার ধারণাটি বলতে গেলে এক নজীরবিহীন পদক্ষেপ ছিল। মিশরিয় ফারাও আখেনাতেন মিশরের অন্যান্য প্রচলিত দেবতাকে অগ্রাহ্য করে সূর্য দেবতার উপাসনার প্রয়াস পেয়েছিলেন, কিন্তু তার উত্তরাধিকারীরা অবিলম্বে সেই নীতিমালা পরিবর্তন করে ফেলেন। মানার সম্ভাব্য উৎসকে অগ্রাহ্য করা সোজাসুজি বোকামি মনে হয়েছে ইসরায়েলিদের। পরবর্তীকালের ইতিহাস আমাদের দেখায়, অন্য দেবতার কাল্ট অগ্রাহ্য করতে দারুণ অনিচ্ছুক ছিল তারা। যুদ্ধে আপন দক্ষতার প্রমাণ রেখেছিলেন ইয়াহ্ওয়েহ্, কিন্তু উর্বরতার দেবতা ছিলেন না তিনি। কানানে বসতি করার পর ইসরায়েলিরা সহজাত প্রবৃত্তির বশেই আবার কানের ভূস্বামী বাআলের কাল্টের আশ্রয় নিয়েছে, যিনি স্মরণাতীত কাল থেকে শস্য উৎপাদন করে আসছিলেন। পয়গম্বরগণ ইসরায়েলিদের চুক্তির শর্ত মেনে চলার অনুরোধ জানিয়েছেন, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী প্রচলিত পদ্ধতিতে বাআল, আশেরাহ, ও আনাতের উপাসনা অব্যাহত রেখেছে। প্রকৃতপক্ষে বাইবেল আমাদের জানাচ্ছে যে, মোজেস সিনাই পর্বতে থাকার সময় বাকি। সবাই কানানের পুরোনো পৌত্তলিক ধর্মে ফিরে গিয়েছিল। তারা প্রচলিত প্রতিমা সোনালি আঁড় তৈরি করে তার সামনে প্রাচীন আচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। সিনাই পর্বত চূড়ার আতঙ্ক জাগানো দিব্যপ্রকাশের বিপরীতে এই ঘটনার উপস্থাপন সম্ভবত পেন্টটিউকের সর্বশেষ সম্পাদকমণ্ডলীর ইসরায়েলের বিভাজনের তিক্ততার রূপ তুলে ধরার একটি প্রয়াস। মোজেসের মতো পয়গম্বরগণ ইয়াহ্ওয়েহ্র উচ্চ ধর্ম প্রচার করেছেন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ দেবতা, প্রকৃতি ও মানুষের মাঝে একতার হলিস্টিক দর্শন মোতাবেক প্রাচীন আচার পালন করতে চেয়েছে।
তারপরও এক্সোডাসের পর ইসরায়েলিরা ইয়াহ্ওয়েহ্কে তাদের একমাত্র ঈশ্বর হিসাবে মানার অঙ্গীকার করেছিল। পরবর্তী বছরগুলোয় পয়গম্বরগণ এই চুক্তির কথা তাদের মনে করিয়ে দেবেন। কেবল ইয়াহ্ওয়েহ্কে এলোহিম হিসাবে উপাসনা করার অঙ্গীকার ছিল তাদের। বিনিময়ে ইয়াহ্ওয়েহ্র প্রতিশ্রুতি ছিল তারা তার বিশেষ জাতিতে পরিণত হবে এবং তার অসাধারণ কার্যকর প্রতিরক্ষা ভোগ করবে। ইয়াহ্ওয়েহ্ তাদের এই বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, চুক্তি ভঙ্গ করলে তিনি তাদের নিষ্ঠুরভাবে ধ্বংস করে দেবেন। কিন্তু তারপরেও ইসরায়েলিরা এই চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল। জশুয়া পুস্তকে আমরা সম্ভবত ইসরায়েল ও তার ঈশ্বরের এই চুক্তির আদি বিবরণ পাই। চুক্তিটি ছিল এক আনুষ্ঠানিক সমঝোতা স্মারক, দুটি পক্ষকে একসঙ্গে আবদ্ধ করার জন্যে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে প্রায়শঃই এর ব্যবহার হতো। একটা নির্দিষ্ট ধরণ অনুসরণ করেছে এটা। চুক্তির টেক্সট শুরু হতো অধিকতর শক্তিশালী রাজার পরিচয় দিয়ে, তারপর বর্তমান কাল পর্যন্ত উভয়পক্ষের সম্পর্কের ইতিহাস বর্ণনা করা হতো। সবশেষে চুক্তির অমর্যাদা হলে শাস্তির প্রকৃতিসহ অপরাপর শর্তাবলী উল্লেখ করা হতো। গোটা চুক্তির অত্যাবশ্যকীয় বিষয়টি ছিল শর্তহীন আনুগত্যের দাবি। চতুর্দশ শতাব্দীতে হিট্টিট রাজা দ্বিতীয় মুরসিলিস এবং তার সামন্ত দুপ্পি তাশেকের মাঝে স্বাক্ষরিত চুক্তি বা কভেন্যান্টে রাজা দাবি তুলেছিলেন: “আর কারও কাছে আশ্রয় চাইবে না। তোমার পিতা মিশরে উপঢৌকন পাঠিয়েছে, তুমি তা করবে না…আমার বন্ধুর সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ব হবে, আমার শত্রুর শত্রু হবে তুমি।’ বাইবেল আমাদের বলছে ইসরায়েলিরা কানানে পৌঁছে আপনজনদের সঙ্গে মিলিত হলে আব্রাহামের সকল বংশধর ইয়াহ্ওয়েহ্র সঙ্গে এক চুক্তিতে উপনীত হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মাজেসের উত্তরাধিকারী জোশুয়া, ইয়াহ্ওয়েহ্র প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। চুক্তিটি প্রচলিত প্যাটার্ন অনুসরণ করেছে। ইয়াহ্ওয়েহ্র পরিচয় দেওয়া হয়েছে, আব্রাহাম, ইসাক ও জ্যাকরের সঙ্গে তার কর্মকাণ্ডের উল্লেখ করা হয়েছে; এরপর এক্সোডাসের ঘটনাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। সবশেষে জোশুয়া চুক্তির শর্তাবলী উল্লেখ করে সমবেত ইসরায়েলি জাতির আনুষ্ঠানিক সম্মতি দাবি করেছেন: