আরও অগ্রসর হতে পারি আমরা। এটা হওয়া খুবই সম্ভব যে আব্রাহামের ঈশ্বর ছিলেন কানানের পরম ঈশ্বর এল। এই দেবতা স্বয়ং আব্রাহামের কাছে নিজের পরিচয় দিয়েছেন এল শাদ্দাই (পর্বতের এল) হিসাবে যা ছিল এল-এর প্রচলিত উপাধির একটি।[৯] অন্যত্র তাঁকে এল এলিয়ন (The Most High god) বা এল অভ বেথেল বলা হয়েছে। কানানের পরম ঈশ্বরের নাম ইসরায়েল বা। ইশমা-এল এর মতো হিব্রু নামে সংরক্ষিত আছে। তারা এমনভাবে তাঁকে প্রত্যক্ষ করেছিল যা মধ্যপ্রাচ্যের পৌত্তলিকদের অপরিচিত ছিল না। আমরা দেখব, বহু শতাব্দী পরে ইসরায়েলিরা ইয়াহ্ওয়েহ্স্র মানা বা ‘পবিত্রতা’-কে ভীতিকর অভিজ্ঞতা হিসাবে আবিষ্কার করেছে। উদাহরণ স্বরূপ, সিনাই পর্বতচূড়ায় এক বিস্ময় ও ভয় জাগানো আগ্নেয়গিরির অগ্নৎপাতের মাঝে মোজেসের সামনে দেখা দেন তিনি, ইসরায়েলিদের তাঁর সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে হয়েছে। সে তুলনায় আব্রাহামের দেবতা এল অনেক নমনীয় উপাস্য। আব্রাহামের সামনে বন্ধু হিসাবে আবির্ভূত হন তিনি, কখনও কখনও এমনকি মানুষের রূপও গ্রহণ করতেন। এপিফ্যানি নামে পরিচিত এক ধরনের অনুপ্রেরণা প্রাচীন পৌত্তলিক সমাজে সর্বজনবিদিত ছিল। যদিও সাধারণভাবে দেবতারা মরণশীল নারী-পুরুষের জীবন-ধারায় সরাসরি ভূমিকা রাখবেন বলে আশা করা হতো না, তবুও পৌরাণিক কালে বিশেষ সৌভাগ্যবান ব্যক্তিরা দেবতাদের প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ লাভ করেছেন। ইলিয়াদ একরম এপিফ্যানিতে পরিপূর্ণ। গ্রিক ও ট্রোজান উভয়ের কাছেই স্বপ্নের মাধ্যমে দেব-দেবীরা। এসেছেন, এই সময় মানবীয় ও স্বর্গীয় জগতের সীমানা প্রাচীর উন্মোচিত হয় বলে বিশ্বাস করা হতো। ইলিয়াদের একেবারে শেষ পর্যায়ে এক আকর্ষণীয়। তরুণ প্রিয়ামকে পথ দেখিয়ে গ্রিক জাহাজ বহরের কাছে নিয়ে যান যিনি শেষ পর্যন্ত নিজেকে হারমিস বলে পরিচয় দিয়েছেন। গ্রিকরা যখন তাদের বীরদের স্বর্ণযুগের কথা ভাবে, তারা অনুভব করে যে সেই বীরগণ দেবতাদের অনেক কাছাকাছি ছিলেন, দেবতারা আবার যা হোক মানব সন্তানদের মতো। একই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। এপিফ্যানির এইসব গল্প হলিস্টিক পৌত্তলিক দর্শন প্রকাশ করেছে: স্বর্গ যখন অত্যাবশ্যকীয়ভাবে প্রকৃতি বা মানুষের চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিল না তখন কোনওরকম ঝামেলা ছাড়াই তার অভিজ্ঞতা লাভ সম্ভব ছিল। জগৎ দেবতায় পরিপূর্ণ ছিল; যে কোনও সময়। অপ্রত্যাশিতভাবে কোনও এক কোণে কিংবা হেঁটে বেড়ানো কোনও পথিকের মাঝে তাদের দেখা মিলে যেতে পারে। মনে হয় সাধারণ মানুষ হয়তো বিশ্বাস। করত যে, এই ধরনের সাক্ষাৎ তাদের জীবনেও সম্ভব পর। এ থেকে অ্যাক্টস অভ দ্য অ্যাপসলস এর অদ্ভুত কাহিনীর ব্যাখ্যা মিলতে পারে। বিসিই প্রথম শতাব্দীর শেষ দিকে বর্তমানে তুরস্ক নামে পরিচিত দেশের লিস্ট্রাবাসী অ্যাপসল পল ও তাঁর শিষ্য বার্নাবাসকে জিউস ও হারমিস বলে ভুল। করেছিল।[১১]
মোটামুটি একইভাবে ইসরায়েলিরা যখন তাদের স্বর্ণযুগের কথা ভাবে, তারা আব্রাহাম, ইসাক ও জ্যাকবকে তাদের ঈশ্বরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ শর্তাধীনে জীবন যাপন করতে দেখে। কোনও শেখ বা চীফটেইনের মতোই এল তাঁদের বন্ধুত্বপূর্ণ উপদেশ দেন: ভ্রমণের সময় পথ দেখান, জানিয়ে দেন কাকে বিয়ে করতে হবে, স্বপ্নে তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন। মাঝে মাঝে তাঁকে মনুষ্য আকৃতিতে দেখতে পান তারা। এই ধারণাটি পরবর্তীকালে ইসরায়েলিদের জন্যে অভিশাপে পরিণত হবে। জেনেসিসের অষ্টাদশ অধ্যায়ে ‘J’ আমাদের বলছেন, হেবরনের নিকটবর্তী মামরির ওক গাছের পাশে আব্রাহামের সামনে আবির্ভূত হলেন ঈশ্বর। দিনের উত্তপ্ততম সময়ে চোখ তুলে তাকিয়ে তিনজন আগন্তুককে নিজ তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসতে দেখেছিলেন আব্রাহাম। মধ্যপ্রাচ্যের স্বাভাবিক আতিথেয়তাবোধ থেকে তিনি ওঁদের বসে বিশ্রাম নেওয়ার ওপর জোর দেন তারপর দ্রুত খাবার তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কথোপকথনের ভেতর দিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এই লোকগুলোর মাঝে একজন তার দেবতা ছাড়া আর কেউ নন, ‘ যাকে সবসময় ইয়াহ্ওয়েহ্’ বলছেন। বাকি দুজন ফেরেশতা বা অ্যাঞ্জেল বলে জানা গেল। এই রহস্য উদঘাটনে কেউই খুব একটা বিস্মিত হয়েছিল বলে মনে হয় না। বিসিই অষ্টম শতাব্দীতে ‘J’ যখন বাইবেল রচনা করছেন, তখন কোনও ইসরায়েলি এভাবে ঈশ্বরকে দেখার প্রত্যাশা করত নাঃ অধিকাংশই এমন ধারণাকে ভীতিকর মনে করত। J’-এর সমসাময়িক ‘E’ ঈশ্বরের সঙ্গে ধর্মপিতাদের অন্তরঙ্গতার গল্পগুলোকে বেমানান মনে করেছেন: আব্রাহাম বা জ্যাকবের কাহিনী বর্ণনার সময় ‘E’ ঘটনাবলীকে বহুকাল আগের বোঝাতে পছন্দ করেছেন এবং প্রাচীন কিংবদন্তীকে মনুষ্য রচনা তুল্য দাবি করার ব্যাপারে সীমা মেনে চলেছেন। এভাবে তিনি বলেছেন, ঈশ্বর একজন ফেরেশতার মাধ্যমে আব্রাহামের সঙ্গে কথা বলেছেন। ‘ অবশ্য এ ধরনের খুঁতখুঁতে মনোভাব পোষণ করেননি, নিজের বর্ণনায় এইসব আদিম এপিফ্যানির পুরোনো স্বাদ বজায় রেখেছেন।
জ্যাকবও বেশ কিছু এপিফ্যানির অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। একবার নিকটজনের মাঝ থেকে একজন স্ত্রী পছন্দ করার জন্যে হারানে প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। যাত্রার প্রথম পর্যায়ে, জর্দান উপত্যকার কাছে লুয (Luz)-এর একটা পাথরকে বালিশের মতো ব্যবহার করে ঘুমিয়ে পড়েন। সেরাতে স্বপ্নে একটা মই দেখতে পান তিনি যেটা স্বর্গ ও পৃথিবীর মাঝে যোগাযোগ স্থাপন করেছে: দেবতা ও মানুষের জগতের মাঝখানে ওঠানামা করছে ফেরেশতারা। মারদুকের যিগুরাতের কথা মনে না করে পারি না আমরা: স্বর্গ ও পৃথিবীর মাঝে ঝুলন্ত যিগুরাতের চূড়ায় একজন মানুষ তার দেবতাদের সঙ্গে মিলিত হতে পারত। মইয়ের শেষ ধাপে জ্যাকব এল-কে দেখেছেন বলে স্বপ্নে দেখলেন, এল তাঁকে আশীর্বাদ করলেন এবং আব্রাহামকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি করলেন: জ্যাকবের বংশধররা এক শক্তিশালী জাতিতে পরিণত হয়ে কানান দেশের মালিক হবে। তিনি আরও একটা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যা জ্যাকবের ওপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব রেখেছিল বলে আমরা। দেখব। পৌত্তলিক ধর্ম প্রায়শঃই এলাকা বা অঞ্চলভিত্তিক হতো: একটা নির্দিষ্ট এলাকায় কেবল বিশেষ দেবতার এখতিয়ার থাকে, বাইরে কোথাও গেলে সেখানকার স্থানীয় দেবদেবীর উপাসনা করাই বুদ্ধিমানের পরিচায়ক। কিন্তু জ্যাকবকে এল প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে জ্যাকব কানান ত্যাগ করে যখন অচেনা দেশে যাবেন তখনও তিনি তাকে রক্ষা করবেন: ‘আমি তোমার সঙ্গে আছি তুমি যেখানেই যাবে, আমি তোমাকে নিরাপদে রাখব। প্রথম দিকের এপিফ্যানির এই কাহিনী দেখায়, কানানের পরম ঈশ্বর অধিকতর বিশ্বজনীন তাৎপর্যের অধিকারী হয়ে উঠতে শুরু করেছিলেন।