দেয়ালের উপরে থাকা এক লোক বাইরের দাঙ্গাবাজদের উদ্দেশ্যে বিচারের রায় চিৎকার করে বলতেই ডেভিড টেবিলের সামনে চলে আসতে পারলেন।
“সান সালপিচের ফাদার অ্যাম্বুয়ের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হচ্ছে!” তার কথাটা মিইয়ে গেলো লোকজনের আনন্দধ্বণির মধ্যে।
“আমি জ্যাক-লুই ডেভিড,” টেবিলের সামনে এসে একজন বিচারকের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললেন তিনি। “আমি বিপ্লবী ট্রাইবুনালের একজন সদস্য। দাঁতোয়াঁ আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন-”
“আমরা আপনাকে ভালো করেই চিনি, জ্যাক-লুই ডেভিড,” টেবিলে বসা। অন্য এক লোক বললো। লোকটার দিকে ফিরে তাকাতেই আৎকে উঠলেন ডেভিড।
মিরিয়ে টেবিলে বসা বিচারকের দিকে তাকাতেই তার রক্ত হিম হয়ে গেলো। এ রকম মুখ কেবলমাত্র দুঃস্বপ্নেই দেখেছে সে। অ্যাবিসের সতর্কতার কথা মনে করলে এরকম একটি মুখ তার সামনে ভেসে ওঠে। আস্ত শয়তানের একটি মুখ।
লোকটার মুখ একেবারেই ভীতিকর। তার শরীরে অসংখ্য কাটা দাগ। মাথায় একটি নোংরা কাপড়ের পট্টি বাধা, সেটা থেকে কালচে তরল ঝরে পড়ছে কপাল বেয়ে। তার চুলগুলো তৈলাক্ত। লোকটাকে দেখে শয়তানের পূর্ণজন্ম হওয়া কোনো পাপাত্মা বলেই মনে হলো মিরিয়ের কাছে।
“আহ, তুমি,” চাপা কণ্ঠে বললেন ডেভিড। “আমি ভেবেছিলাম তুমি…”
“অসুস্থ?” জবাবে বললো লোকটা। “এতোটা অসুস্থ নই যে আমার দেশের সেবা করতে পারবো না।”
মিরিয়ের কানে কানে ফিসফিস করে বললেন ডেভিড, “তুমি কিচ্ছু বোলো না। আমরা ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে আছি।”
টেবিলে বসা বিচারকের দিকে ঝুঁকে কথা বললেন ডেভিড।
“আমি দাঁতোয়াঁর ইচ্ছেয় এখানে এসেছি, এই ট্রাইবুনালে সাহায্য করার জন্য,” বললেন তিনি।
“আমাদের কোনো সাহায্য লাগবে না, নাগরিক, ঝাঁঝের সাথে বললো লোকটা। “শুধুমাত্র এখানেই বিচার হবে না। প্রতিটি জেলখানায়ই রাষ্ট্রের শত্রুদের ভরে রাখা হয়েছে। এখান থেকে কাজ শেষ করে আমরা পরেরটায় যাবো। বিচারের কাজে কোনো স্বেচ্ছাসেবকের দরকার নেই আমাদের। দাঁতোয়াঁকে গিয়ে বলবেন আমরা এখানে আছি। ভালো লোকজনের হাতেই বিচার হচ্ছে।”
“বেশ,” লোকটার পিঠ চাপড়িয়ে বললেন ডেভিড, ঠিক এই সময় আরেকটা মরণচিৎকার শোনা গেলো। “আমি জানি তুমি একজন সম্মানিত নাগরিক এবং অ্যাসেম্বলির সদস্য। কিন্তু একটা সমস্যা হয়ে গেছে। আমি নিশ্চিত তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারবে।”
মিরিয়ের হাতটা শক্ত করে ধরলেন ডেভিড। মেয়েটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
“আমার ভাতিজি আজ দুপুরের দিকে এই জেলখানার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো, দুর্ঘটনাবশত তাকে ভুল করে এখানে ধরে আনা হয়েছে। আমার বিশ্বাস…মানে আশা করছি তার কিছু হয় নি, কারণ মেয়েটা একেবারে সহজ সরল, রাজনীতির সাথে তার কোনো সম্পর্কই নেই। জেলখানার ভেতরে তাকে খুঁজে দেখো।”
“আপনার ভাতিজি?” ডেভিডের দিকে ঝুঁকে বললো জঘন্য লোকটা। “তাকে আর কষ্ট করে খোঁজার দরকার নেই। এখনই তাকে ট্রাইবুনালের সামনে নিয়ে আসা হবে। আমরা জানি কারা আপনার তত্ত্বাবধানে ছিলো। এই মেয়েটাও তার মধ্যে আছে।” মিরিয়ের দিকে না তাকিয়েই মাথা নেড়ে বললো লোকটা। তারা অভিজাত পরিবারের সন্তান, দ্য রেমি বংশের মেয়ে। মন্তগ্লেইন অ্যাবি থেকে তারা এসেছে। জেলখানার ভেতরে আপনার ভাতিজিকে আমরা এরইমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি।”
“না!” ডেভিডের হাত থেকে ছুটে চিৎকার করে বললো মিরিয়ে। “ভ্যালেন্টাইন! আপনারা তার কি করেছেন?” টেবিলে বসা শয়তানটাকে শক্ত করে ধারে বললো সে। ডেভিড টেনে সরিয়ে দিলেন তাকে।
“বোশমি কোরো না,” দাঁতে দাঁত পিষে বললেন তিনি। মিরিয়ে আবারো তার হাত থেকে ছুটে গেলে জঘন্য বিচারকটি হাত তুললো। টেবিলের পেছনে জেলখানার সিঁড়ি থেকে ধাক্কা মেরে দু’জনকে ফেলে দেয়া হলে একটা হৈচৈ শুরু হয়ে গেলো। মিরিয়ে দৌড়ে গেলো সিঁড়ির দিকে। ভ্যালেন্টাইন আর তরুণ এক যাজক পড়ে আছে সেখানে। যাজক নিজের পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভ্যালেন্টাইনকেও উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো। মিরিয়ে ছুটে এসে জাপটে ধরলো তার বোনকে।
“ভ্যালেন্টাইন, ভ্যালেন্টাইন,” চিৎকার করে বললো সে। ভ্যালেন্টাইনের ক্ষতবিক্ষত মুখ। ঠোঁট কাটা।
“ঐ খুঁটিগুলো,” ফিসফিস করে বললো ভ্যালেন্টাইন, প্রাঙ্গনের দিকে উদভ্রান্তের মতো তাকালো সে। “ক্লদ আমাকে বলেছেন খুঁটিগুলো কোথায়। আছে। মোট ছয়টি…”
“ওগুলো নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো না,” বোনকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বললো মিরিয়ে। “আমাদের আঙ্কেল এখানে এসেছেন। আমরা তোমাকে মুক্ত করে নিয়ে। যাবো…”
“না!” চিৎকার করে বললো ভ্যালেন্টাইন। “তারা আমাকে হত্যা করবে, বোন। তারা ওগুলোর কথা জেনে গেছে…তোমার কি ঐ ভুতটার কথা মনে আছে! দ্য রেমি, দ্য রেমি,” বিড়বিড় করে বললো সে। উদভ্রান্তের মতো নিজের পারিবারিক পদবীটা আওড়াতে লাগলো। তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো মিরিয়ে।
ঠিক তখনই একজন সৈনিক এসে মিরিয়েকে ধরে ফেললো। ডেভিডের দিকে বিস্ময়ে তাকালো সে। তিনি টেবিলে বসা বিচারকের দিকে ঝুঁকে প্রাণপণ বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দু’জন লোক এসে ভ্যালেন্টাইনকে ধরলে মিরিয়ে সৈনিকের হাতে কামড় বসিয়ে দিলো। ট্রাইবুনালের সামনে দাঁড় করানো হলো ভ্যালেন্টাইনকে। দু’পাশে দু’জন সৈনিক তাকে ধরে রেখেছে। চকিতে মিরিয়ের দিকে তাকালো সে, তার মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে আছে। তারপরই হাসলো সে, তার সেই হাসি যেনো কালো মেঘের আড়ালে এক টুকরো রোদের উন্মেষ। কিছুক্ষণের জন্য শান্ত হয়ে উঠলো মিরিয়ে, বোনের হাসির জবাবে সেও হেসে ফেললো। এরপরই টেবিলের পেছন থেকে কিছু লোকের কণ্ঠ শুনতে পেলো সে। সেটা যেনো তার মনে চাবুকের মতো শপাং করে আঘাত করলো, প্রাঙ্গনের দেয়ালে প্রতিধ্বণিত হলো সেই কথাটা।