বিকেল ৪টা
এমন কি লাবায়ে জেলখানার বাইরে লোকজনের উলু ধ্বণি এর ভেতর থেকে উৎসারিত কানফাটা চিৎকারকে ছাপিয়ে যেতে পারলো না। মিরিয়ে কখনই এই আওয়াজটার স্মৃতি মুছে ফেলতে পারবে না।
দরজায় আঘাত করতে থাকা লোকগুলো এখন ক্লান্ত হয়ে বন্দীদের নিয়ে আসা ঘোড়াগাড়িগুলোর ছাদে উঠে বসেছে। গাড়িগুলো নিহত যাজকদের রক্তে স্নাত। জেলখানার সামনের সরু গলিটায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছিন্নভিন্ন মানব অঙ্গ।
প্রায় এক ঘণ্টা আগে ভেতরের বিচার কাজ শুরু হয়েছে, এখনও সেটা চলছে। কিছু শক্তিশালী লোক জেলখানার দেয়ালের উপর উঠে হাতের বলুম ছুঁড়ে মারছে ভেতরের প্রাঙ্গনে।
এক লোক অন্য আরেক লোকের কাঁধে উঠে চিৎকার করে বললো, “নাগরিকগণ, দরজা খুলে দাও! আজকে ন্যায়বিচার করতে হবে!”
একটা বিশাল কাঠের দরজা খুলে যেতেই লোকজন উৎফুল্ল হয়ে আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলো। সেই ভোলা দরজা দিয়ে হুরমুর করে প্রবেশ করতে শুরু করলো তারা।
কিন্তু একদল সৈন্য জনস্রোতকে আটকে দিলো সাহসের সাথে। ঠেলেঠুলে তাদেরকে দরজার বাইরে বের করে আবার বন্ধ করে দিলো সেটা। মিরিয়ে এবং অন্যেরা ভেতরে যে তামাশার বিচার চলছে সেটা শোনার জন্যে দেয়ালের উপরে বসে থাকা লোকগুলোর জন্যে অপেক্ষা করলো।
জেলখানার গেটে আবারো আঘাত করলো মিরিয়ে, কিন্তু সবটাই বৃথা। ক্লান্ত হয়ে সে গেটের পাশেই বসে রইলো এ আশায় যে আবারো কয়েক মুহূর্তের জন্য গেটটা খোলা হলে সবার অলক্ষ্যে ঢুকে পড়তে পারবে।
অবশেষে তার আশা পূর্ণ হলো। বিকেল চারটার দিকে মিরিয়ে দেখতে পেলো গলির দিক থেকে একটা ছাদ খোলা ঘোড়াগাড়ি ছুটে আসছে, পথের উপর পড়ে থাকা ছিন্নভিন্ন মৃতদেহগুলো সাবধানে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে আসছে ঘোড়াগুলো। গাড়ির পেছনে বসে থাকা লোকটাকে দেখে বন্দীদের ঘোড়াগাড়িগুলোর ছাদে বসে থাকা কিছু মহিলা উল্লাস করতে শুরু করল উপস্থিত করলো। লোকজনও গাড়িটার দিকে ছুটে যেতে শুরু করলো উল্লাস করতে করতে। বিস্ময়ে উঠে দাঁড়ালো মিরিয়ে। এটা তো ডেভিড!
“আঙ্কেল, আঙ্কেল!” চিৎকার করতে করতে ছুটে গেলো সে গাড়িটার দিকে, তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছে। তাকে দেখতে পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে গা থামাতে বলে ছুটে এলেন ডেভিড। লোকজনের ভীড় ঠেলে জড়িয়ে ধরলেন তাকে।
“মিরিয়ে!” লোকজন তার পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে, স্বাগত জানাচ্ছে, সেগুলোর দিকে তার কোনো মনোযোগ নেই। “কি হয়েছে? ভ্যালেন্টাইন কোথায়?” তার চোখেমুখে তীব্র আতঙ্ক।
“ও জেলখানার ভেতরে আছে,” কেঁদে কেঁদে বললো মিরিয়ে। “আমরা এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম…আমি জানি না কী ঘটে গেছে, আঙ্কেল। হয়তো দেরি হয়ে গেছে।”
“আসো আসো,” মিরিয়েকে জড়িয়ে ধরে লোকজনের ভীর ঠেলে ডেভিড চলে এলেন জেলখানার গেটের কাছে। তাকে অনেকেই চিনতে পেরে পথ করে দিলো দ্রুত।
“গেট খোলো!” দেয়ালের উপরে থাকা কিছু লোক চিৎকার করে ভেতরের লোকগুলোকে বললো। “নাগরিক ডেভিড এখানে এসেছে! চিত্রশিল্পী ডেভিড!”
কিছুক্ষণ পরই একটা বিশাল গেট খুলে গেলে ডেভিডকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে আবারো বন্ধ করে ফেলা হলো সাথে সাথে।
জেলখানার প্রাঙ্গনটি রক্তে রঞ্জিত। এক সময় যেটা মোনাস্টেরির বাগান ছিলো সেখানে এক যাজক বসে আছে, তার মাথাটা কাঠের একটি ব্লকে আঁটকে রাখা হয়েছে পেছন দিক থেকে। রক্তে লাল হওয়া ইউনিফর্ম পরা এক সৈনিক তলোয়াড় হাতে যাজকের ঘাড়ে কোপ বসালেও সেটা বিচ্ছিন্ন করতে পারলো না, ফলে গলগল করে রক্ত বের হতে লাগলো যাজকের অর্ধকর্তিত ঘাড় থেকে। সৈনিক বার কয়েক কোপ বসালো, তাতেও মৃত্যু হলো না যাজকের, ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে লোকটার ক্ষতস্থান থেকে। তার মুখ হা হয়ে থাকলেও কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না।
পুরো প্রাঙ্গণ জুড়ে লোকজন ছুটে বেড়াচ্ছে, টপকে যাচ্ছে পড়ে থাকা বীভৎস লাশ। ঠিক কতোজনকে কচুকাটা করা হয়েছে সেটা বোঝা প্রায় অসম্ভব। সুন্দর করে ছাটা ঘসের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মানুষের হাত-পা, ধর আর মুণ্ডু।
এসব দেখে মিৱিয়ে চিৎকার দিতে উদ্যত হলো। তাকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে আশ্বস্ত করলেন ডেভিড। নিজেকে শান্ত রাখো তা না হলে
আমরা ওকে খুঁজে বের করতে পারবো না।”
চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন ডেভিড। তার সামনে এক সৈনিক দাঁড়িয়ে আছে, পোশাকে রক্ত লেগে রয়েছে তার। মুখটাও রক্তাক্ত, তবে সে নিজে আহত হয় নি, এই রক্ত নিহতদের।
“এখানকার দায়িত্বে আছে কে?” বললেন ডেভিড। সৈনিক হেসে ফেললো, তারপর জেলখানার প্রবেশপথের সামনে বিশাল একটি কাঠের টেবিলে বসে থাকা কয়েকজন লোকের দিকে ইঙ্গিত করলো সে। লোকগুলোর সামনে ছোটোখাটো একটা ভীড় তৈরি হয়েছে।
মিরিয়ে আর ডেভিড টেবিলের দিকে এগোতেই দেখতে পেলো তিনজন যাজককে টেনে হিঁচড়ে সেই টেবিলের সামনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারপর বেয়নেট দিয়ে তো মেরে তাদেরকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য করলো কিছু সৈনিক।
টেবিলে বসে থাকা পাঁচজন লোক একে একে যাজকদের সাথে কথা বললো। তাদের মধ্যে একজন হাতের সামনে থাকা একটি কাগজে দ্রুত কিছু। লিখে মাথা ঝাঁকালো কেবল।
যাজকদের টেবিলের সামনে থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো প্রাঙ্গনের মাঝখানে, চারদিক থেকে লোকজন হর্ষধ্বণি প্রকাশ করতে লাগলো আসন্ন মুণ্ডুপাত দেখার জন্য। যাজকদের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। তাদের চোখেমুখে মৃত্যুভয়। ভালো করেই জানে কি ঘটতে যাচ্ছে। মিরিয়েকে নিয়ে দ্রুত সেই টেবিলের সামনে চলে এলেন ডেভিড। কিন্তু বিচারকদের সামনে এখন উফুলু লোকজন জড়ো হয়ে আছে, ফলে তাদের কারণে সামনে এগোতে পারলেন না। তিনি।