“আর সঙ্গিতকেও,” বাখ বলতে লাগলেন, “গণিতে রূপান্তর করা যায়, আর সেটার ফল খুব বিস্ময়কর হয়ে থাকে। এই মহাবিশ্বের স্থপতি এভাবেই এটার ডিজাইন করেছেন। মহাবিশ্ব সৃষ্টি এবং সভ্যতা ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে। সঙ্গিতের। আমার কথা বিশ্বাস না হলে বাইবেল পড়ে দেখতে পারেন।”
ইউলার চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। “হ্যাঁ,” অবশেষে তিনি বললেন, “বাইবেলে আরো কিছু স্থপতি আছে যাদের গল্পগুলো বেশ চমকপ্রদ, তাই না?”
“বন্ধু, মুচকি হেসে আমার দিকে ফিরে বললেন বাখ, “আমি যেমনটি বলেছি, খুঁজুন, তাহলেই পেয়ে যাবেন। যে সঙ্গিতের স্থাপত্য বুঝতে পারবে সে মন্তগ্লেইন সার্ভিসের ক্ষমতাও বুঝতে পারবে। যেহেতু এ দুটো জিনিস একই।”
.
ডেভিড তার নিজের বাড়ির লোহার দরজার সামনে এসে ফিলিদোরের দিকে তাকালেন।
“কিন্তু এসবের মানে কি?” জানতে চাইলেন। “সঙ্গিত আর গণিতের সাথে মন্তগ্লেইন সার্ভিসের কি সম্পর্ক? আর এসব কিছুর সাথে স্বর্গ-মর্ত্যের ক্ষমতারই বা কি সম্পর্ক আছে বুঝতে পারছি না? আপনার কাছে যে গল্পটা শুনলাম সেটা আমার আগের ধারণাটাকেই আরো পোক্ত করলো। কিংবদন্তীর মন্তগ্লেইন সার্ভিসটা আধ্যাত্মবাদ আর বোকাদেরই শুধু আকর্ষণ করে। এরকম আজগুবি জিনিসের ব্যাপারে ড. ইউলারের মতো লোকজন জড়িত জানতে পেরে আমার কাছে মনে হচ্ছে তিনি বোধহয় খুব সহজেই ফ্যান্টাসির শিকার হতেন।”
ডেভিডের গেটের কাছে বিশাল একটি গাছের নীচে থামলেন ফিলিদোর। “এই বিষয়টা নিয়ে আমি অনেক বছর ধরেই গবেষণা করে গেছি,” চাপা কণ্ঠে বললেন দাবাড়ু এবং সঙ্গিতকার। “অবশেষে ইউলার এবং বাধের কথামতো বাইবেলও স্টাডি করেছি আমি, যদিও এরকম কোনো ধর্মপুস্তকের ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ ছিলো না। আমাদের সাক্ষাতের কিছুদিন পরই বাখ মারা যান আর ইউলার চলে যান রাশিয়াতে। তিনি ওখানকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ফলে এই দু’জন মানুষের সাথে আমার আর সাক্ষাত করার সুযোগ ঘটে নি। তাদের সাথে আমি আলোচনা করতে পারি নি বাইবেল পড়ে কি খুঁজে পেয়েছিলাম।”
“আপনি কি খুঁজে পেয়েছিলেন?” গেটের তালায় চাবি ঢোকাতে ঢোকাতে বললেন ডেভিড।
“তারা আমাকে স্থপতির ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, আমি তাই খুঁজেছিলাম। বাইবেলে দু’জন স্থপতির কথা উল্লেখ আছে। একজন হলেন এই মহাবিশ্বের স্থপতি ঈশ্বর আর অন্যজন বাবেল টাওয়ারের স্থপতি। ‘বাব-এল’ শব্দটির মানে জনতে গিয়ে আমি দেখলাম এর অর্থ ঈশ্বরের দরজা। ব্যাবিলনিয়ানরা খুব গর্বিত জাতি ছিলো। সভ্যতার সূচনালগ্নে তারাই ছিলো সবচাইতে মহান সভ্যতার প্রতিষ্ঠাতা। প্রকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে তারা উদ্যান বানিয়েছিলো। তারা এমন একটি টাওয়ার বানাতে চেয়েছিলো যা স্বর্গ ছুঁয়ে ফেলতে সক্ষম হবে। এমন একটি টাওয়ার যা পৌঁছে যাবে সূর্যের কাছে। আমি নিশ্চিত, বাইবেলের এই গল্পটাই বাখ এবং ইউলারকে আকর্ষণ করেছিলো।
“এর স্থপতি ছিলেন,” তারা দুজন গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ফিলিদোর বলতে লাগলেন, “নিমরদ, যাকে কোরানে নমরুদ নামে অভিহিত করা হয়েছে, নিজের সময়ে একজন মহান স্থপতি ছিলেন। তিনি এমন একটি উঁচু টাওয়ার বানিয়েছিলেন যা ঐ সময়কার মানুষের কাছে অকল্পনীয় একটি ব্যাপার ছিলো। তবে সেটা সমাপ্ত করা যায় নি। আপনি কি জানেন কেন?”
“যতোদূর মনে পড়ে ঈশ্বর গজব নাজেল করেছিলেন,” বাড়ির ভেতরে প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে ডেভিড বললেন।
“তিনি কিভাবে এই গজবটা নাজেল করেছিলেন?” জানতে চাইলেন ফিলিদোর।
“তিনি বজ্রপাতের সাহায্যে কিংবা প্লাবন সৃষ্টি করে তা করেন নি, যেমনটি তিনি সব সময় করে থাকেন! আমি বলছি কিভাবে তিনি নিমরদের কাজটা ধ্বংস করেছিলেন। নির্মাণ শ্রমিকদের ভাষা এলোমেলো করে দিয়েছিলেন ঈশ্বর। শ্রমিকেরা সবাই একটা ভাষায়ই কথা বলতো। তিনি সেই ভাষার উপর আঘাত হানেন। শব্দ ধ্বংস করে ফেলেন!”
ঠিক এমন সময় ডেভিড দেখতে পেলেন তার বাড়ির এক চাকর তার দিকে ছুটে আসছে। “ঈশ্বর তাহলে এভাবেই একটা সভ্যতাকে ধ্বংস করে ফেললেন? মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে? কিংবা ভাষার মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে আমাদের ফরাসিদের এ নিয়ে কোনোদিনও চিন্তা করার কিছু থাকবে না। আমরা আমাদের ভাষার খুবই অনুরক্ত, এটাকে আমরা স্বর্ণের মতো মূল্যবান মনে করি!”
“সম্ভবত আপনার অধীনে থাকা ঐ দুই তরুণী এই রহস্যটার সমাধানে সাহায্য করতে সক্ষম হবে, যদি তারা সত্যিই মন্তগ্লেইনে থেকে থাকে তো,” জবাবে বললেন ফিলিদোর। আমি বিশ্বাস করি এটা একটা শক্তি। ভাষার যে সঙ্গিত তার শক্তি-সঙ্গিতের গণিত। ঈশ্বর যে শব্দের সাহায্যে এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, ব্যাবিলন সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়েছিলেন এটা তারই সিক্রেট-আমি বিশ্বাস করি এই সিক্রেটটা রাখা আছে মন্তগ্লেইন সার্ভিসের ভেতরে।”
ডেভিডের চাকর তার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো।
“পিয়েরে, কি হয়েছে?” অবাক হয়ে ডেভিড জানতে চাইলেন।
“ঐ দুই তরুণী, ভয়ার্ত চোখেমুখে বললো পিয়েরে নামের কাজের লোকটা। “তারা উধাও হয়ে গেছে, মঁসিয়ে।”
“কি?!” চিৎকার করে উঠলেন ডেভিড। “তুমি এসব কি বলছো?”
“সেই বেলা দুটোর পর থেকে তারা বাড়িতে নেই, মঁসিয়ে। সকালে তারা। একটা চিঠি পায়। বাগানে গিয়ে সেই চিঠিটা পড়ে দু’জনে। লাঞ্চের সময় তাদের খোঁজ করতে গেলে দেখি তারা নেই। আমার মনে হচ্ছে বাগানের দেয়াল টপকে চলে গেছে-এছাড়া আর কোনোভাবে যাওয়া সম্ভব নয়। এখনও তারা ফিরে আসে নি।”