“কিন্তু গণিত তো সঙ্গিতই,” জবাবে বললেন বাখ। এর উল্টোটাও সত্য। আপনারা যদি বিশ্বাস করে থাকেন মিউজিক’ শব্দটি এসেছে মুসা, মিউজেস’ অথবা ‘মিউটা’ থেকে, যার অর্থ দাঁড়ায় ওরাকলের মুখ, তাহলেও ঐ একই কথা খাটে। আর যদি ভাবেন ম্যাথমেটিকস’ এসেছে ম্যাথানেইন’ কিংবা ম্যাট্রিক্স থেকে যাদের অর্থ জরায়ু অথবা সকল সৃষ্টির মাতা, তাহলেও একই কথা…”
“আপনি শব্দ নিয়েও স্টাডি করেছেন?” ইউলার বললেন।
“সৃষ্টি এবং হত্যা করার ক্ষমতা রয়েছে শব্দের,” বললেন বাখ। “যে মহান স্থপতি আমাদের এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন তিনি শব্দেরও জন্ম দিয়েছেন। সত্যি বলতে কি, আমরা যদি নিউ টেস্টামেন্টের সেন্ট জনের কথায় বিশ্বাস রাখি তাহলে বলতে হয়, তিনি প্রথমে শব্দই সৃষ্টি করেছেন।”
“আপনি কি বললেন? মহান স্থপতি?” ইউলারের মুখ কিছুটা ফ্যাকাশে হয়ে। গেলো।
“আমি ঈশ্বরকে স্থপতি নামে ডাকি, কারণ তিনি প্রথমে শব্দের ডিজাইন করেছেন,” জবাবে বললেন বাখ। প্রথমে ছিলো শব্দ,’ মনে আছে? কে জানে? হয়তো এটা নিছক শব্দ না। হয়তো এটা সঙ্গিত। হতে পারে ঈশ্বর তার নিজের তৈরি করা অন্তহীন এক সঙ্গিত গেয়ে চলেছেন, আর এর মাধ্যমেই এই বিশ্বজগৎ মূর্ত হয়ে উঠেছে।”
ইউলার সূর্য নিরীক্ষণ করতে গিয়ে এক চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেললেও অন্য চোখে পিটপিট করে তাকালেন পিয়ানোর উপর রাখা নাইট টুরের দিকে। দাবাবোর্ডের ডায়াগ্রামে থাকা অসংখ্য ছোটো ছোটো সংখ্যাগুলোর উপর হাত বুলিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে গেলেন তিনি। তারপর কথা বললেন এই গণিতজ্ঞ।
“আপনি এসব জিনিস কোথায় শিখেছেন?” সুরস্রষ্টাকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। “আপনি যা বললেন সেটা খুবই গুপ্ত আর বিপজ্জনক একটি সিক্রেট, কেবলমাত্র ইনিশিয়েটরাই এটা জানতে পারে।”
“আমি ইনিশিয়েট হয়েছি,” শান্তকণ্ঠে বললেন বাখ। “ওহ, আমি জানি অনেক সিক্রেট সোসাইটি আছে যারা সারা জীবন ব্যয় করে যাচ্ছে এই মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচন করতে। তবে আমি সেসব সোসাইটির সদস্য নই। আমি আমার নিজের পদ্ধতিতে সত্যান্বেষণ করি।”
এ কথা বলেই পিয়ানোর উপর থেকে ইউলারের ফর্মুলাটি হাতে তুলে নিলেন। বাখ। তারপর কালির দোয়াত থেকে একটা পালক তুলে নিয়ে সেটার উপরে কিছু শব্দ লিখে দিলেন : কোয়ারেন্দো ইনভেনিতিস। খোঁজো, তাহলেই তুমি পাবে। এবার নাইট টুরটা তুলে দিলেন আমার হাতে।
“আমি বুঝতে পারছি না,” কিছু বুঝতে না পেরে বললাম।
“হের ফিলিদোর,” বললেন বাখ, “আপনি ড. ইউলারের মতো একজন দাবা মাস্টার এবং আমার মতো একজন সঙ্গিতকার। একজন ব্যক্তির মধ্যে এরকম দুটো অতি মূল্যবান দক্ষতা রয়েছে।”
“মূল্যবান কোন দিক থেকে?” ভদ্রভাবেই জানতে চাইলাম। “আমার বলতে কোনো কার্পন্য নেই, এ সবের মধ্যে আমি আর্থিক কোনো মূল্যই খুঁজে পাই নি!” হেসে ফেললাম আমি।
“টাকার চেয়েও যে শক্তিশালী ক্ষমতাবান কিছু জিনিস এই মহাবিশ্বে কাজ করছে এই সত্যটা খুব কম সময়ই মানুষ বুঝতে পারে,” মুচকি হেসে বললেন বৃদ্ধ সঙ্গিতকার। “উদাহরণ দিয়েই বলি-আপনি কি কখনও মন্তগ্লেইন সার্ভিসের নাম শুনেছেন?”
ইউলার আৎকে উঠলে আমি চমকে তার দিকে তাকালাম।
“বুঝতেই পারছেন,” বললেন বাখ, “আমাদের বন্ধু হের ডক্টরের কাছে নামটা মোটেই অচেনা নয়। সম্ভবত এ বিষয়ে আমিও আপনাকে কিছুটা আলোকপাত করতে পারবো।”
আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বাখের অদ্ভুত গল্পটা শুনে গেলাম। এই দাবাবোর্ডটি এক সময় শার্লেমেইনের কাছে ছিলো, জনশ্রুতি আছে ওটার মধ্যে নাকি অসাধারণ এক ক্ষমতা রয়েছে। সঙ্গিতকার তার কথা শেষ করে আমাকে বললেন :
“আমি আপনাদের দু’জনকে আজ এখানে আসতে বলেছি একটা এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য। সারা জীবন ধরে আমি সঙ্গিতের চমকপ্রদ ক্ষমতা নিয়ে স্টাডি করে গেছি। এর যে নিজস্ব একটা ক্ষমতা রয়েছে সেটা খুব কম লোকেই অস্বীকার করতে পারে। একটা জংলী পশুকে শান্ত করে তুলতে পারে এটা, আবার শান্তশিষ্ট কোনো মানুষকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য রক্ত গরম করে দিতেও পারে। আমি আমার নিজের এক্সপেরিমেন্টের মধ্য দিয়ে সঙ্গিতের এই ক্ষমতার সিক্রেটটা জানার চেষ্টা করেছি। সঙ্গিতের নিজস্ব যুক্তি আছে। এটা অনেকটা গণিতের মতোই তবে কিছু দিক থেকে একটু ভিন্নতা রয়েছে। সঙ্গিত আমাদের মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি কমিউনিকেট করে না, তবে এটা দুর্বোধ্য এক পদ্ধতিতে আমাদের চিন্তাভাবনাকে বদলে দেয়।”
“আপনি এ দিয়ে কি বোঝাতে চাচ্ছেন?” জানতে চাইলাম আমি। তবে আমি ভালো করেই জানতাম বাখ আমার ভেতরে একটা কর্ডে টোকা মেরে দিয়েছেন যা কোনোভাবেই বলে বোঝাতে পারছিলাম না। আমার কাছে মনে হলো অনেক বছর ধরেই আমি এটা জানি। আমার ভেতরে সুপ্ত থাকা কিচ সাদা চমৎকার এক সঙ্গিতের মূৰ্ছনায় জেগে উঠছে। অথবা আমি দাবা খেলছি।
“আমি বলতে চাচ্ছি,” বললেন বাখ, “এই মহাবিশ্ব অনেকটা দল গাণিতিক খেলার মতো, যা সীমাহীন বিশালত্বের একটি স্কেলের উপর চলেছে। সঙ্গিত হলো সবচাইতে বিশুদ্ধ গণিতের একটি রূপ। প্রতিটি ফর্মূলাকে সঙ্গিতে রুপান্তর করা যেতে পারে, ঠিক যেমনটি আমি করেছি ড. ইউলারের ফর্মূলাটি নিয়ে।
ইউলারের দিকে বাখ তাকাতেই তিনি মাথা নেড়ে সায় দিলেন। যেনো তারা। দু’জন এমন একটি সিক্রেট জানেন যেটা এখনও কেউ জানে না।