মাথা নীচু করে ইয়োহান সেবাস্তিয়ান বাখ অপূর্ব সুন্দর আর প্রাণ হরণ করা। একটি সঙ্গিত বাজাতে শুরু করলেন। মনে হলো অন্তহীন এক পাখির গান সেটা। এক ধরণের ফিউগো ছিলো ওটা, আমি সেই রহস্যময় দুর্বোধ্যতা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ওনে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম তিনি কি করেছেন। সুরের প্রতিটি স্টানজা একটি হারমোনি-কি থেকে শুরু হয়ে অন্য একটি উপরের কি-তে গিয়ে শেষ হচ্ছে, আর এটা চললো রাজার নিজের থিমটা ছয়বার রিপিট হওয়া পর্যন্ত, তবে যে কি থেকে শুরু করেছিলেন সেখানে এসেই তিনি শেষ করলেন। তারপরও পালা বদলটি কোথায় ঘটলো, কিভাবে ঘটলো সেটা আমার কাছেও বোধগম্য হলো না। ওটা ছিলো জাদুর মতো একটি কাজ। অনেকটা সাধারণ ধাতুকে সোনায় বদলে ফেলার মতো একটি ব্যাপার। সঙ্গিতটির চাতুর্যপূর্ণ গঠন শুনে আমার মনে হলো এটা বিরামহীনভাবেই অসীমতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। যতোক্ষণ না সরগুলো দেবদূতেরা শুনতে পায়।
“অসাধারণ!” বাখ থামতেই রাজা বলে উঠলেন। হাতেগোনা কয়েকজন জেনারেল আর সৈনিকের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিলেন তিনি।
“এই স্ট্রাকচারটাকে কি নামে ডাকা হয়?” জানতে চাইলাম বাখের কাছে।
“আমি এটাকে বলি ‘Ricercar,” বৃদ্ধ আমাকে বললেন। চমৎকার একটি সঙ্গিত সৃষ্টি করার পরও তার গুরুগম্ভীর অভিব্যক্তি পাল্টালো না। “ইতালিতে এটাকে বলে অম্বেষণ’। এটা সঙ্গিতের খুবই প্রাচীন একটি ফর্ম। এখন আর এ ধরণের সঙ্গিতের চল নেই।” কথাটা বলে তিনি তার ছোটো ছেলে কার্ল ফিলিপের দিকে তিক্তমুখে তাকালেন। তার এই ছেলে জনপ্রিয় ধারার সঙ্গিত রচনা করতেন।
রাজার পাণ্ডুলিপিটা তুলে নিয়ে সেটার উপরে Ricercar শব্দটি দ্রুত লিখে ফেললেন। শব্দটির প্রতিটি অক্ষরকে একেকটি লাতিন শব্দে রূপান্তর করলেন তিনি। ফলে এরকম দাঁড়ালো : রেজিস ইসু কান্তিও এত রেলিকুয়া কানোনিকা আর্তে রেজুলুতা। সাদামাটাভাবে এটার অর্থ দাঁড়ায়, রাজা কর্তৃক ইস্যু হওয়া সঙ্গিত, বাকিটা ক্যাননের শিল্পের মাধ্যমে সম্পন্ন। ক্যানন হলো এমন এক ধরণের সঙ্গিত যেখানে প্রতিটি পার্ট একটা নির্দিষ্ট হিসেবে মাপা থাকে, তবে পুরো সঙ্গিতটি ওভারল্যাপিং ফ্যাশনে। যেনো চিরকাল বহমান, এরকম একটি ভাব তৈরি করে এটি।
এরপর বাখ মিউজিক শিটের মার্জিনে দুটো লাতিন বাক্য লিখলেন। সেগুলো অনুবাদ করার পর দাঁড়ালো এরকম :
স্বরগুলোর বিস্তৃতির সাথে সাথে রাজার সৌভাগ্যও প্রসারিত হবে।
সুরের সম্প্রসারণ হবার সাথে সাথে রাজার মহিমাও বৃদ্ধি পাবে।
ইউলার এবং আমি বৃদ্ধ সঙ্গিতকারকে তার চাতুর্যপূর্ণ কাজের জন্য প্রশংসা করলাম। এরপর আমাকে একই সাথে রাজা, ডক্টর ইউলার এবং বাখের ছেলে উইলহেমের সাথে চোখ বেধে দাবা খেলার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। যা যদিও দাবা খেলেন নি কিন্তু খেলা দেখেছিলেন বেশ মনোযোগ দিয়ে, তিনজনকেই হারিয়ে দেই আমি। খেলা শেষে ইউলার আমাকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে যান।
“তোমার জন্য আমার কাছে একটা উপহার আছে, আমাকে বললেন তিনি। “আমি একটা নতুন নাইট টুর আবিষ্কার করেছি। এটা একটা গাণিতিক ধাঁধা। আমার বিশ্বাস দাবা খেলায় এ পর্যন্ত যতোগুলো নাইট টুর আবিষ্কৃত হয়েছে আমারটা তারমধ্যে সবচাইতে সেরা। তবে তুমি যদি কিছু মনে না করো আমি ওটার একটা কপি বৃদ্ধ বাধকে দিতে চাই আজ রাতে। তিনি গাণিতিক খেলা খুব পছন্দ করেন, এটা তাকে বেশ আনন্দ দেবে।”
আমাদের কাছ থেকে উপহারটা অদ্ভুত হাসির সাথে গ্রহণ করলেন বাব। আন্তরিকভাবেই ধন্যবাদ জানালেন তিনি। “আমি বলি কি, হের ফিলিদোর চলে। যাবার আগে আপনারা আগামীকাল সকালে আমার কটেজে চলে আসুন, বললেন তিনি। “তাহলে আপনাদের জন্যে আমি ছোট্ট একটা সারপ্রাইজ প্রস্তুত করে রাখতে পারবো।” আমরা খুব কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। কথা দিলাম অবশ্যই কাল সকালে তার ওখানে যাবো।
পরের দিন সকালে কার্ল ফিলিপের কটেজের দরজা খুলে বাখ আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। ওখানে ছোট্ট একটা পার্লারে বসলাম আমরা। তিনি আমাদের চা পান করতে দিলেন। এরপর ছোট্ট একটা পিয়ানোর সামনে বসে একেবারে অন্য রকম একটি সঙ্গিত বাজাতে শুরু করলেন তিনি। বাজানো শেষ করলে আমি এবং ইউলার একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম।
“এটাই হলো আপনাদের সারপ্রাইজ!” সন্তুষ্ট ভঙ্গিতে বললেন বাখ। তার মুখের গুরুগম্ভীর অভিব্যক্তি বদলে গেলো। মনে হলো অনেক খুশি হয়েছেন। তবে বুঝতে পারলেন ইউলার এবং আমি কিছুই ধরতে পারছি না।
“শিট মিউজিকটা একটু দেখুন,” বললেন বাখ। আমরা দু’জনে উঠে পিয়ানোর সামনে চলে গেলাম। শিট মিউজিক বলতে কিছুই ওখানে নেই, আছে গতরাতে ইউলারের দেয়া নাইট টুরের সেই কপিটা। জিনিসটা বিশাল দাবাবোর্ডের একটি মানচিত্র, যার প্রতিটি বর্গে সংখ্যা লেখা। বাখ এইসব সংখ্যাগুলোর সাথে চমৎকার কিছু লাইনের সম্পর্ক তৈরি করেছেন, সেগুলো আমার কাছে ধরা পড়ে নি। তবে ইউলার একজন গণিতজ্ঞ, তার মাথা আমার চেয়ে দ্রুত কাজ করে।
“আপনি এইসব সংখ্যাগুলোকে অক্টেভ আর কর্ডে রূপান্তর করেছেন। তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন। “কিন্তু আমাকে দেখাতে হবে এটা আপনি কিভাবে করলেন। গণিতকে সঙ্গিতে পরিণত করা-এটা তো সাংঘাতিক জাদু!”