.
গল্পটা বলা শেষ হলে ক্যাথারিন আর অ্যাবিস নির্বাক হয়ে বসে রইলেন হার্মিটেজের বিশাল লাইব্রেরিতে। এই লাইব্রেরিতেই আছে ভলতেয়ারের জানালগুলো। ত্রিশ ফুট উঁচু দেয়ালজুড়ে এই লাইব্রেরিতে রয়েছে অসংখ্য বই পুস্তক আর দলিল-দস্তাবেজ। বেড়াল যেমন ইঁদুরের দিকে তাকায় ঠিক সেভাবে অ্যাবিসের দিকে তাকালেন ক্যাথারিন। লাইব্রেরির বিশাল জানালা দিয়ে অ্যাবিস চেয়ে আছে বাইরে। রাজকীয় বৃক্ষীটি সেখানে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে। আছে।
“আমার প্রয়াত স্বামী, নরম কণ্ঠে বললেন ক্যাথারিন, “প্রুশিয়ার ফ্রেডারিক দ্য গ্রেটের খুবই অনুরক্ত ছিলেন। পিটার্সবার্গের রাজদরবারে প্রশিয়ার তৈরি একটি ইউনিফর্ম পরতেন পিটার। আমাদের বাসররাতে তিনি প্রুশিয়ার সৈন্যের খেলনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছিলেন বিছানায়, আমাকে দিয়ে সেগুলো ড্রিলও করিয়েছিলেন। ফ্রেডারিক যখন অনেকটা জোর করেই ফ্রম্যাসন অর্ডারকে প্রুশিয়ায় নিয়ে আসেন তখন পিটার সেই দলে যোগ দেন, প্রতিজ্ঞা করেন আজীবন তিনি তাদের সমর্থন দিয়ে যাবেন।”
“আর এ কারণেই তুমি তোমার স্বামীকে ক্ষমতাচ্যুত করে জেলে ভরে রাখলে, তাকে হত্যা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করলে,” বললেন অ্যাবিস।
উনি খুবই বিপজ্জনক রকমের ম্যানিয়াক হয়ে উঠেছিলেন,” বললেন। ক্যাথারিন। “তবে তার মৃত্যুর সাথে আমি সরাসরি জড়িত নই। ছয় বছর পর ১৭৬৮ সালে সিলেসিয়াতে আফ্রিকান আর্কিটেক্টদের জন্যে একটি লজ নির্মাণ করেন ফ্রেডারিক। সুইডেনের রাজা গুস্তাভাস এই দলে যোগ দেন, মারিয়া টেরেসা অস্ট্রিয়া থেকে এইসব জঘন্য লোকদেরকে বের করে দেবার অনেক প্রচেষ্টা চালানো সত্ত্বেও দেখা গেলো তার নিজেরই ছেলে দ্বিতীয় জোসেফ ওই সোসাইটিতে যোগ দিয়ে বসে আছে। এসব কথা জানার পর পরই আমি দেরি না করে আমার পুরনো বন্ধু ডক্টর ইউলারকে রাশিয়ায় নিয়ে আসি।
“তিনি ততোদিনে বেশ বয়স্ক হয়ে গেছেন, তার দু’চোখই অন্ধ হয়ে গেছে। তবে তার দিব্যজ্ঞান একটুও কমে নি। ভলতেয়ার মারা গেলে ইউলারই আমাকে তার লাইব্রেরটিটা কিনে নেয়ার জন্য তাগিদ দেন। ওই লাইব্রেরিতে এমন কিছু দলিল-দস্তাবেজ ছিলো যা ফ্রেডারিক দি গ্রেট মরিয়া হয়ে পেতে চাইছিলেন। লাইব্রেরিটা কিনে পিটার্সবার্গে নিয়ে আসার পর আমি এসব জানতে পারি। এগুলো তোমাকে দেখানোর জন্য রেখে দিয়েছি।”
ভলতেয়ারের পাণ্ডুলিপি থেকে একটা পার্চমেন্টের ডকুমেন্ট বের করে অ্যাবিসের কাছে দিলেন সম্রাজ্ঞি, সাবধানে সেটার ভাঁজ খুললেন তিনি। ভলতেয়ারকে লেখা প্রশিয়ার অস্থায়ী সম্রাট যুবরাজ ফ্রেডারিকের একটি চিঠি। যে বছর ফ্রেডারিক ম্যাসনে ঢুকেছিলেন ঠিক সেই বছরের তারিখে লেখা :
মঁসিয়ে, আপনার সমস্ত লেখা আমার কাছে থাকবে এরচেয়ে বড় কোনো আকাঙ্খা আমার নেই…এরমধ্যে যদি কোনো
পাণ্ডুলিপি আপনি লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে চান, আমিও সেগুলোকে গোপন রাখতে বদ্ধপরিকর হবো…
কাগজ থেকে মুখ তুলে তাকালেন অ্যাবিস। তার দুচোখ উদাসী, উঠলো। আস্তে করে চিঠিটা ভাঁজ করে ক্যাথারিনের হাতে তুলে দিলে তিনি সেই আগের জায়গায় রেখে দিলেন।
“এটা কি পরিস্কার নয়, তিনি আসলে ভলতেয়ারের করা রিশেলুর ডায়রিটার সাংকেতিক ভাষা উদ্ধারের কথা বলছেন?” সম্রাজ্ঞি জানতে চাইলেন। ৯ সিক্রেট সোসাইটিতে যোগদানের পর থেকেই তিনি এই তথ্যটা পাবার চেষ্টা করে গেছেন। এখন হয়তো তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে…”
চামড়ায় বাধানো আরেকটা ভলিউম তুলে নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ওল্টাতে ওল্টাতে নির্দিষ্ট একটি পৃষ্ঠায় এসে থামলেন ক্যাথারিন। বহুদিন আগে যে কথা কোডের আকারে লিখে গেছেন কার্ডিনাল রিশেলু সেটা জোরে জোরে পড়ে শোনালেন অ্যাবিসকে :
অবশেষে প্রাচীন ব্যাবিলনিয়াতে যে সিক্রেটটা আবিষ্কৃত হয়েছিলো সেটা আমি খুঁজে পেয়েছি। এই সিক্রেটটা পারস্য আর ভারতীয় সাম্রাজ্যেও পরিবাহিত হয়েছিলো। কেবলমাত্র মনোনীত করা হাতেগোণা কিছু লোকই সেটা জানতো, সেই সিক্রেটটা হলো মন্তগ্লেইন সার্ভিস। ঈশ্বরের পবিত্র নামের মতো এই সিক্রেটটা কখনও কোনো ভাষায় লেখা হয় নি। এই সিক্রেটটা এমনই শক্তিশালী যে সভ্যতার পতন কিংবা রাজ-রাজাদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে না। গুপ্তসংঘে দীক্ষিত হওয়া ছাড়া কেউ এটা জানতে পারে না। যারা দীক্ষিত হয়েছে তাদেরকে কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে উত্তীর্ণ হতে হয়, তারপর নিতে হয় শপথ। এই জ্ঞান এতোটাই মারাত্মক যে সিক্রেট সোসাইটির শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ ছাড়া অন্য কাউকে এর হেফাজতের দায়িত্ব দেয়া হয় না। আমার বিশ্বাস, এই সিক্রেটটি ফর্মুলার আকারে রাখা হয়েছে, আর এই ফর্মুলাই সর্বকালের সব সাম্রাজ্যের পতনের কারণ। আমাদের বর্তমান সময়ে সাম্রাজ্য হয়ে উঠেছে রূপকথা। সিক্রেট জ্ঞানে দীক্ষিত হওয়া এবং এর ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত হওয়া সত্ত্বেও মুররা এই ফর্মুলাটিকে মন্তগ্লেইন সার্ভিসে লিপিবদ্ধ করে গেছে। তারা পবিত্র সিম্বলগুলো দাবাবোর্ডের বর্গ আর খুঁটির মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে, এই ফর্মুলার চাবি পাবে কেবলমাত্র এই খেলাটার একজন মাস্টার, সে-ই পারবে তালাটা খুলতে। অনেকগুলো প্রাচীন পাণ্ডুলিপি পড়ে আমি এই ধারণায় উপনীত হয়েছি। এই পাণ্ডুলিপিগুলো জোগার করা হয়েছে শালোয়া, সয়সোয় আর তুর থেকে, তারপর আমি নিজে সেগুলো অনুবাদ করেছি।