“বলবো আপনাকে,” হেসে বললেন ফিলিদোর। “তবে আপনি যদি আপনার ঐ দুই তরুণীর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিন তাহলে। সম্ভবত আমরা এই রহস্যটার কূলকিণারা করতে পারবো। আপনি হয়তো জানেন না এই রহস্যটা উন্মোচন করতে গিয়ে আমি আমার সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছি!”
ডেভিড তার কথায় রাজি হয়ে তাকে নিজের স্টুডিওতে নিয়ে আসার জন্যে। রওনা হলেন।
বাতাসের কোনো গতি নেই। গাছের পাতাও নড়ছে না। প্রচণ্ড গরমের একটা দিন। মাটি তেঁতে আছে সেই প্রখর গরমে। সাইন নদীও যেনো সমস্ত উদ্দামতা হারিয়ে ধীরগতিতে বইছে। তারা তখনও জানে না বিশ ব্লক দূরে, কর্নেলিয়ার প্রাণকেন্দ্রে একদল রক্তপিপাসু দাঙ্গাবাজ লাবায়ের জেলখানার প্রধান ফটকটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আর সেই জেলখানার ভেতরেই আছে ভ্যালেন্টাইন।
তারা দু’জন যখন পায়ে হেঁটে স্টুডিওর পথে এগিয়ে যাচ্ছে তখনই ফিলিদোর তার গল্পটা বলা শুরু করলেন…
দাবা মাস্টারের গল্প
উনিশ বছর বয়সে আমি ফ্রান্স ছেড়ে হল্যান্ডে যাত্রা করি একটা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে, উদ্দেশ্য ওখানে এক অল্পবয়সী এডিজি পিয়ানো বাদক মেয়ের সাথে বাজাবো। কিন্তু হল্যান্ড গিয়েই শুনি মেয়েটা কয়েক সপ্তাহ আগে গুটিবসন্তে মারা গেছে। কপর্দকহীন হয়ে আমি বিদেশের মাটিতে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। আয়রোজগারের কোনো আশাও ছিলো না সেখানে। কোনো রকম খেয়েপরে বেঁচে থাকার জন্য আমি কফিহাউজগুলোতে গিয়ে দাবা খেলতে শুরু করি।
চৌদ্দ বছর বয়স থেকেই আমি বিখ্যাত দাবা মাস্টার স্যার দ্য লিগ্যালের অধীনে দাবা চর্চা শুরু করেছিলাম। উনি ছিলেন ইউরোপের সেরা খেলোয়াড়। আঠারো বছর বয়সে আমি তাকে নাইট ছাড়াই হারাতে সক্ষম হতাম। খুব দ্রুত বুঝতে পারলাম আমি যেকোনো খেলোয়াড়কেই হারিয়ে দিতে পারি। আমাকে হেগে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো ফন্টিনয় যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। চারপাশে যখন যুদ্ধ চলছে তখন যুবরাজ ওয়ালডেকের সাথে দাবা খেলেছিলাম।
আমি সমগ্র ইংল্যান্ড ভ্রমণ করি, ওখানকার কসাইদের কফিহাউজে গিয়ে প্রায় সব সেরা দাবাড়ুদের সাথেই খেলি, তার মধ্যে স্যার অ্যাব্রাহাম জেনসেন এবং ফিলিপ স্টামাও ছিলো। তাদের সাবইকে আমি হারিয়ে দেই। সম্ভবত স্টামা একজন সিরিয়ান কিংবা মুরিশ বংশোদ্ভূত ছিলেন। দাবার উপর বেশ কয়েকটি বই লিখেছিলেন তিনি। সেইসব বইসহ লা বোদোয়া আর মারিচালের বই দুটো আমাকে দেখিয়ে বলেছিলেন, আমারও দাবার উপর বই লেখা উচিত।
এর কয়েক বছর পরই আমার বই প্রকাশ হয়। সেটার শিরোনাম ছিলো অ্যানালাইস দু জুয়ে দে এসচেক। তাতে আমি দাবা খেলা নিয়ে একটা তত্ত্বের কথা বলি, সৈনিকেরা হলো দাবার প্রাণ। ওই বইতে আমি দেখাই সৈন্যেরা শুধুমাত্র বলি দেয়ার বস্তু নয়, তাদেরকে কৌশলগত এবং অবস্থানগতভাবে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কার্যকরীভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই বইটা দাবা খেলার জগতে একটি বিপ্লব বয়ে আনে।
আমার কাজ জার্মান গণিতবিদ ইউলারের মনোযোগ আকৃষ্ট করে। দিদেরোর প্রকাশিত ফরাসি দিকশনেয়া’তে আমার চোখ বেধে খেলার কথা প্রকাশিত হলে তিনি ফ্রেডারিককে দিয়ে তার রজদরবারে আমাকে নিমন্ত্রণ করেন।
ফ্রেডারিক দি গ্রেটের রাজদরবারটি পটসডামে অবস্থিত, বিশাল, চোখ ধাঁধানো আর সূক্ষ্ম কারুকাজ করা এই দরবারটি ইউরোপের সেরা হিসেবে বিবেচিত। ফ্রেডারিক নিজে একজন যোদ্ধা বলে তার রাজসভায় সব সময় কিছু সৈনিক, শিল্পী আর নারী থাকতো। তিনি এদের সঙ্গ খুব পছন্দ করতেন। বলা হয়ে থাকে তিনি কাঠের শক্ত তক্তার উপরে ঘুমাতেন, পাশে রাখতেন তার প্রিয় কুকুরগুলো।
আমি যে রাতে রাজদরবারে যাই সেই রাতে লিপজিগের সভাসঙ্গিতকার বাখ তার ছেলে উইলহেমকে নিয়ে উপস্থিত হন আরেক ছেলে কার্ল ইমানুয়েল বাধে সাথে যোগ দিতে। ইমানুয়েল বাখের ছিলেন ফ্রেডারিকের রাজদরবারের সঙ্গিতকার। ফ্রেডারিক নিজে আট বার-এর একটি ক্যানন কম্পোজ করেছিলেন, সিনিয়র বাখকে তিনি অনুরোধ করেছিলেন ঐ থিমটার উপরে কিছু ইপ্রোভাইজ করার জন্য। আমাকে বলা হয়েছিলো, এই বৃদ্ধ সঙ্গিতকার জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক বিষয়ে আগ্রহী। তিনি জিশু এবং নিজের নামে কিছু ক্যানন রচনা করেছিলেন আর সেগুলোকে লুকিয়ে রেখেছিলেন গাণিতিক নোটেশনের হারমোনির ভেতরে। তিনি একই সাথে বেশ কয়েকটি জটিল আর বিপরীত মেলোডি একসূত্রে গেথে এমন একটা হারমোনি তৈরি করতেন যা হতো মূল মেলোডির ঠিক বিপরীত চিত্রের মতো।
ইউলার প্রস্তাব করলেন, বৃদ্ধ সঙ্গিতকার যেনো ‘দ্য ইনফিনিট’-এর স্ট্রাকচারের মধ্যে একটি ভ্যারিয়েশন আবিষ্কার করেন। এই ইনফিনিটি মানে ঈশ্বর তার সমগ্র সৃষ্টির মধ্যেই উদ্ভাসিত। রাজা এ কথাটা শুনে খুব খুশি হলেন কিন্তু তার ধারণা ছিলো বাখ এটা করবেন না। আমি নিজে একজন সঙ্গিতকার হিসেবে বলতে পারি, অন্যের সঙ্গিতের উপর বাড়তি কিছু কারুকাজ করা ছোটোখাটো কাজ নয়। একবার আমি জঁ জ্যাক রুশোর একটি থিমের উপর অপেরা কম্পোজ করেছিলাম। দার্শনিক রুশোর বয়স তখন খুব কম ছিলো। কিন্তু সঙ্গিতের মধ্যে এ ধরণের ধাঁধা লুকিয়ে রাখাটা…একেবারেই অসম্ভব একটি কাজ।
তবে আমাকে অবাক করে দিয়ে বাখ তার জামার হাতা গুটিয়ে কিবোর্ডের সামনে বসে গেলেন। ভারি শরীর, বিশাল আকৃতির নাক, শক্ত চোয়াল আর জ্বলজ্বলে চোখ ছিলো তার। ইউলার আমার কানে কানে বললেন, বৃদ্ধ বাখ। ফরমায়েশি কাজ করেন না। নির্ঘাত তিরি রাজার অনুরোধের জবাবে একটা তামাশা করবেন।