“আপনিই তাহলে সেই বিখ্যাত ফিলিদোর!” অবাক হয়ে বলেই বুড়ো লোকটার হাত ধরে ফেললেন ডেভিড। “আপনি তো বিখ্যাত সুরকার, সঁসিয়ে। আমি যখন অনেক ছোটো ছিলাম তখন আপনার লো সোলদাত ম্যাজিশিয়ান দেখেছিলাম। জীবনেও ভুলতে পারবো না সেটা। দয়া করে আমাকে আমার পরিচয়টা দিতে দিন, আমি জ্যাক-লুই ডেভিড।”
“বিখ্যাত পেইন্টার!” উঠে দাঁড়িয়ে বললেন ফিলিদোর। “ফ্রান্সের অন্য সবার মতো আমিও আপনার চিত্রকর্মের দারুণ ভক্ত। তবে বলতে বাধ্য হচ্ছি, এ দেশে আপনিই হলেন একমাত্র ব্যক্তি যে আমাকে মনে রেখেছে। যদিও এক সময় আমার সঙ্গিত কমেদি-ফ্রাসোঁয়া আর অপেরা-কমিকে নিয়মিত পরিবেশিত হতো কিন্তু বর্তমানে আমি প্রশিক্ষিত বানরের মতো দাবা খেলে দু’পয়সা রোজগার করে সংসার চালাই। রোবসপাইয়ে আমার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে দারুণ উপকার করেছে, একটা পাস জোগার করে দিয়েছে আমাকে, যাতে করে এ দেশ ছেড়ে ইংল্যান্ডে চলে যেতে পারি, ওখানে আমি দাবা খেলে ভালোই রোজগার করতে পিরবো।”
“আমিও ঠিক এরকম উপকার চাইতে এসেছি তার কাছে, রোবসপাইয়ে নিজেও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালে বললেন ডেভিড। এই মুহূর্তে প্যারিসের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। আর সেজন্যেই আমি এখানে ছুটে এসেছি, জানি না উনি আমার অনুরোধ রাখবেন কিন.।”
“নাগরিকেরা সব সময়ই অন্যের কাছ থেকে একটু সুবিধা পেতে চায়, শান্তকণ্ঠে বললো রোবসপাইয়ে।
“আমি আমার তত্ত্বাবধানে থাকা অল্পবয়স্কা দুটো মেয়ের জন্যে এসেছি, দৃঢ়ভাবে বললেন ডেভিড। “আমি নিশ্চিত আপনি নিজেও মনে করেন না এ মূহূর্তে অল্পবয়স্ক তরুণীদের জন্যে ফ্রান্স কোনো নিরাপদ জায়গা।”
“আপনি যদি তাদের নিয়ে এতোটাই চিন্তিত হয়ে থাকেন তাহলে,” নাক সিটকিয়ে বললো রোবসপাইয়ে, “আঁতুয়ার বিশপের মতো লোকের বাহুবন্ধনে তাদেরকে প্যারিসের পথেঘাটে ছেড়ে দিতেন না।”
“আমি একটু ভিন্নমত পোষণ করবো,” ফিলিদোর কথার মাঝখানে ঢুকে পড়লেন। “মরিস তয়িরাঁর দারুণ ভক্ত আমি। আমার অনুমাণ একদিন এই লোকটা ফ্রান্সের ইতিহাসে মহান রাষ্ট্রনায়ক হয়ে উঠবে।”
“অনুমাণ হিসেবে একটু বেশিই হয়ে গেছে,” বললো রোবসপাইয়ে। “ভাগ্য ভালো যে, আপনি লোকজনের ভাগ্য গণনা করে জীবিকা নির্বাহ করেন না। কয়েক সপ্তাহ ধরে মরিস উঁয়িরা ফ্রান্সের সরকারী কর্মকর্তাদের ঘুষ সেধে যাচ্ছে তাকে যেনো কূটনৈতিক হিসেবে ইংল্যান্ডে যাবার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। লোকটা এখন নিজের মাথা বাঁচাতে ব্যস্ত। মাই ডিয়ার ডেভিড, প্রশিয়ান সেনাবাহিনী এসে পড়ার আগে ফ্রান্সের সব অভিজাত লোকজন দেশ ছাড়তে চাইছে। আজরাতে কমিটির মিটিংয়ে আপনার ঐ দুই তরুণীর ব্যাপারে কী করা যায় সেটা নিয়ে কথা বলবো তবে এ মুহূর্তে কোনো কথা দিতে পারছি না। আপনি একটু দেরি করে ফেলেছেন।”
ডেভিড তাকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে যাবার সময় তার সাথে সাথে বের হলেন দাবা মাস্টার ফিলিদোর। তিনিও ক্লাব থেকে বের হতে যাচ্ছিলেন এ সময়। জনাকীর্ণ ক্লাবঘর থেকে বের হবার সময় ফিলিদোর বললেন, “আপনাকে বুঝতে হবে রোবসপাইয়ে আপনার এবং আমার থেকে একটু ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। একজন অবিবাহিত লোক হিসেবে সন্তানের প্রতি কি রকম দায়িত্ব থাকতে হয় সেটা সে জানে না। আপানার তত্ত্বাবধানে যে মেয়ে দুটো আছে তাদের বয়স কতো, ডেভিড? কতোদিন ধরে তারা আপনার তত্ত্বাবধানে আছে?”
“দু’বছরের বেশি সময় ধরে আমার কাছে আছে,” বললেন ডেভিড। “আমার কাছে আসার আগে তারা ছিলো মন্তগ্লেইন অ্যাবির অ্যাপ্রেন্টিস নান…”
“আপনি কি বললেন, মন্তগ্লেইন?” ক্লাবের গেট দিয়ে বের হবার সময় কণ্ঠে বললেন ফিলিদোর। মাই ডিয়ার ডেভিড, একজন দাবা খেলোয়াড়ে, আমি আপনাকে জোর দিয়ে বলতে পারি মন্তগ্লেইন অ্যাবির ইতিহাস ম আমি বেশ ভালোই জানি। আপনি কি তাদের ইতিহাসটা জানেন না?”
“হ্যাঁ, জানি,” একটু বিব্রত হয়ে বললেন ডেভিড। “সবটাই গালগল্পো। মন্তগ্লেইন সার্ভিসের কোনো অস্তিত্ব নেই। আপনার মতো লোক এর গালপপ্লো বিশ্বাস করে শুনলে আমি অবাকই হবে।”
“গালগপ্পো?” রাস্তায় নামতেই ফিলিদোর ডেভিডের হাতটা ধরলেন। “বন্ধ। আমি জানি ওটার অস্তিত্ব আছে। আমি আসলে তারচেয়েও বেশি কিছু জানি। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে, আপনি সম্ভবত জন্মান নি তখন, প্রশিয়ার ফ্রেডারিকের রাজদরবারে গিয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে এমন দুজন লোকের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম যাদের ছিলো অনুধাবন করার অসম্ভব ক্ষমতা। আমি জীবনেও সেটা ভুলবো না। একজনের কথা আপনি নিশ্চয় শুনে থাকবেন-মহান গণিতজ্ঞ লিওনহার্ড ইউলার। অন্যজন ফ্রেডারিকের বাবার সময়কার সভাসঙ্গিতকার। তবে এই বৃদ্ধলোকটি তখন একেবারে ফুরিয়ে গেছে, বলতে পারেন, তার সমস্ত প্রখরতা যেনো বয়সের ধুলোবালিতে চাপা পড়ে গেছে। সমগ্র ইউরোপ তখনও তার কথা শোনে নি। তবে রাজার সুনরোধে এক রাতে তিনি যখন আমাদের সামনে তার সঙ্গিত পরিবেশন করলেন তখন বুঝতে পারলাম এ জীবনে এরকম বিশুদ্ধ সঙ্গিত আর কখনও শুনি নি। তার নাম ইয়োহান সেবাস্তিয়ান বাব।”
“এ নাম তো শুনি নি,” ডেভিড স্বীকার করলেন, “কিন্তু ইউলার আর এই সঙ্গিতকারের সাথে লিজেন্ডারি মন্তগ্লেইন সার্ভিসের সম্পর্কটা কি?”