পাথরের দেয়ালের উপর আছড়ে পড়লো সে, তারপর কাকড় বিছানো পথের উপর। ভেজা আর উষ্ণ কিছু টের পেলো মিরিয়ে। মাথা তুলে চোখের সামনে থেকে চুল সরাতেই দেখতে পেলো সিস্টার ক্লদের ভোলা চোখ দুটো। লাবায়ে জেলখানার দেয়ালের নীচে পড়ে আছে সে। সারা মুখে রক্ত। মাথার স্কার্ফটা ছিন্নভিন্ন। স্পষ্ট দেখতে পেলো কপালের বাম দিকটা ফেটে চৌচিড় হয়ে আছে। চোখ দুটো শূন্যে তাকিয়ে আছে যেনো। মিরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রাণপনে চিৎকার করার চেষ্টা করলো কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। তার গলা আর্টকে এলো। তার হাতে যে ভেজা আর উষ কিছু টের পেয়েছিলো সেটা আর কিছু না। সিস্টার ক্লদের ছিঁড়ে ফেলা হাতের অংশ।
ভয়ে দূরে সরে গেলো মিরিয়ে। উদভ্রান্তের মতো হাতের রক্ত মুছে ফেললো নিজের গাউনে। ভ্যালেন্টাইন! কোথায় তার বোন? পশুর মতো কতোগুলো মানুষ তার দিকে এগিয়ে আসতেই দেয়াল ধরে হাটু মুড়ে উঠে বসলো সে, ঠিক তখনই একটা গোঙানি শুনে বুঝতে পারলো সিস্টার ক্লদ এখনও বেঁচে আছে!
সিস্টারকে জড়িয়ে ধরলো মিরিয়ে।
“ভ্যালেন্টাইন!” চিৎকার করে বললো সে। “ভ্যালেন্টাইন কোথায়? আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারছেন? ভ্যালেন্টাইনের কি হয়েছে, বলুন?”
মৃতপ্রায় নান কোনো রকম বলতে পারলো, “ভেতরে, তার কথাটা একেবারে ফিসফিসানির মতো শোনালো। “তারা তাকে লাবায়ের ভেতরে নিয়ে গেছে।” তারপরই জ্ঞান হারালো আবার।
“হায় ঈশ্বর, আপনি কি নিশ্চিত?” মিরিয়ে বললো কিন্তু কোনো জবাব পেলো না।
উঠে দাঁড়ালো সে। রক্তপিপাসু দাঙ্গাবাজরা তার দিকেই ছুটে আসছে। চারদিকে দা, কুড়াল, শাবল, গাইতি আর নানা রকম ভয়ঙ্কর অস্ত্রের ঝনঝনানি। সেইসাথে তাদের জান্তব উল্লাস আর কিছু মানুষের বেঁচে থাকার করুণ আর্তনাদ মিলেমিশে এমন বিকট শব্দ সৃষ্টি করেছে যে মাথা ভনভন করতে শুরু করলো। লাবায়ের দরজায় জোরে জোরে আঘাত করতে গিয়ে তার হাত রক্তাক্ত হয়ে গেলো।
ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। ক্লান্ত-ভগ্ন মনে বুঝতে পারলে এখান। থেকে সরে গিয়ে ঘোড়াগাড়িটার কাছে যেতে হবে, হয়তো সেটা এখনও আশেপাশেই আছে। তারপর খুঁজে বের করতে হবে ডেভিডকে। কেবলমাত্র ডেভিডই তাদেরকে সাহায্য করতে পারবে এখন।
হঠাৎ করেই সে বরফের মতো জমে গেলো জনারণ্যের মাঝখানে। লোকজনের ভীড়ের ফাঁক গলে চোখে পড়লো একটা ভয়াবহ দৃশ্য। যে গাড়িটায় করে তারা এসেছিলো সেটা এখন দাঙ্গাবাজদের কবলে পড়ে গেছে। সেটাকে টানতে টানতে মিরিয়ে দিকেই নিয়ে আসা হচ্ছে। সেই গাড়ির ড্রাইভারের আসনে একটা বলুমের মাথায় তাদের ড্রাইভারের খণ্ডিত মস্তক। লোকটার সিলভার রঙের চুল আর রক্তাক্ত মুখমণ্ডল দেখে গা শিউড়ে উঠলো তার।
নিজের ভেতর থেকে আসা চিৎকারটা থামানোর জন্য নিজের হাতে কামড় বসিয়ে দিলো মিরিয়ে। বুঝতে পারলো ডেভিডকে আর খুঁজতে পারবে না সে। তাকে এখন লাবায়ের ভেতরে যেতে হবে। আর এখন যদি ভ্যালেন্টাইনের কাছে না যেতে পারে তাহলে এই জীবনে আর কখনই সেটা সম্ভব হবে না।
বিকেল : ৩টা
জ্যাক-লুই ডেভিড উঠে আসা বাস্পের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। পাথর বিছানো উত্তপ্ত রাস্তার উপরে মহিলারা বালতি ভরে ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দেয়ার কারণে এই বাষ্প। তিনি প্রবেশ করলেন ক্যাফে দ্য লা রিজেন্সিতে।
ডজনখানেক লোক ভেতরে বসে পাইপ আর সিগার খাচ্ছে ফলে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন পুরো ক্লাবঘরটি। ডেভিডের চোখে এসে লাগলো সেটার আঁচ। কোনো রকম ভীড় ঠেলেঠুলে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে। প্রতিটি টেবিলে তাস, ডমিনো আর দাবা খেলে যাচ্ছে লোকজন। ক্যাফে দ্য লা রিজেন্সি হলো ফ্রান্সের সবচাইতে পুরনো খেলাধুলার ক্লাব।
ঘরের পেছনে চলে এলেন ডেভিড। দেখতে পেলেন ম্যাক্সিমিলিয়েঁ রোবসপাইয়ে একটা টেবিলে বসে নিবিষ্টমনে দাবা খেলে যাচ্ছে। তার মধ্যে অসম্ভব শান্ত আর ধীরস্থির মনোভাব, চারদিকের হৈহল্লার কোনা কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। বাস্তবেও লোকটা বরফের মতোই শীতল। আর দাবা খেলার সময় আশেপাশের কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করে না।
রোবসপাইয়ের বিপরীতে যে বৃদ্ধ লোকটি বসে আছে ডেভিড তাকে চিনতে পারলেন না। পুরনো দিনের নীল কোট আর সাদা মোজা পরে আছে, বেশভূষা দেখতে একেবারে পঞ্চদশ লুইয়ের মতো। কোনো দিকে না তাকিয়েই বুড়ো লোকটা চাল দিলো। ডেভিড কাছে আসতেই মুখ তুলে তাকালো সে।
“আপনার খেলায় বিঘ্ন ঘটানোর জন্য আমি খুবই দুঃখিত,” বললেন ডেভিড। “মঁসিয়ে ম্যাক্সিমিলিয়ে রোবসপাইয়েকে আমি একটা জরুরি অনুরোধ করতে এসেছি।”
“ঠিক আছে, কোনো সমস্যা নেই,” বললেন বুড়ো লোকটা। রোবসপাইয়ে এখনও চুপচাপ দাবাবোর্ডটি নিরীক্ষণ করে যাচ্ছে। আমার বন্ধু খেলায় হেরে গেছে। তার রাজা চেক হয়ে গেছে। তুমি খেলা থেকে ছুটি নিতে পারো ম্যাক্সিমিলিয়ে। তোমার বন্ধু ঠিক সময়েই এসে পড়েছে।”
“আমি তো এটা দেখতে পাচ্ছি না,” বললো রোবসপাইয়ে। অবশ্য দাবার ব্যাপারে আপনার চোখ আমার চেয়েও ভালো, সেটা আমি জানি।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাবাবোর্ড থেকে চোখ সরিয়ে ডেভিডের দিকে তাকালো সে। “মঁসিয়ে ফিলিদোর হলেন ইউরোপের সবচাইতে সেরা দাবা খেলোয়াড়। তার সাথে হেরে যাওয়াটাও অনেক সম্মানের ব্যাপার। এক টেবিলে বসে যে খেলছি। সেটাই তো অনেক কথা।”