“মাদাম, ভাগ্য ভালো থাকলে আমি হয়তো আপনাকে আজরাতের মধ্যে অ্যাম্বাসিতে ফেরত পাঠাতে পারবো। প্রুশিয়ানদের সাথে লড়াই করে জেতার আগে স্বয়ং ঈশ্বরও আপনাকে শহরের গেটের বাইরে নিয়ে যেতে পারবে না। আপনার ব্যাপারটা নিয়ে আমি দাঁতোয়াঁর সাথে কথা বলবো।”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো জার্মেইন। “জেনেভাতে যখন আমার বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হবে তখন আমি তার নাম রাখবো আপনার নামে।”
দুপুর : ২টা
ডেভিডের স্টুডিও থেকে অনেকটা পালিয়ে এসে একটা ঘোড়াগাড়ি ভাড়া করে লাবায়ে জেলখানার সামনে চলে এলো মিরিয়ে এবং ভ্যালেন্টাইন। রাস্তায় লোকেলোকারণ্য, বেশ কয়েকটি গাড়ি জেলখানার সামনে আর্টকে দেয়া হলো।
দাঙ্গাবাজ লোকগুলো হাতে দা-কুড়াল আর লাঠিসোটা নিয়ে জেলখানার গেটের কাছে থেমে থাকা ঘোড়াগাড়িগুলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গাড়িগুলোর দরজা আর জানালার উপর আঘাত করতে শুরু করলো তারা চারপাশ থেকে। তাদের গর্জনে প্রকম্পিত হলো দু’পাশে পাথরের দেয়ালের মাঝখানে থাকা সরু পথটা। জেলখানার রক্ষীরা ঘোড়াগাড়িগুলোর ছাদে উঠে লোকজনকে দূরে সরানোর বৃথা চেষ্টা করছে।
মিরিয়ে আর ভ্যালেন্টাইনের গাড়ির ড্রাইভার ঝুঁকে জানালা দিয়ে উঁকি মারলো ভেতরে।
“আমি আর বেশি কাছে যেতে পারবো না,” বললো তাদেরকে। “আরেকটু এগোলেই গলির মধ্যে আটকা পড়ে যাবো। তাছাড়া এইসব দাঙ্গাবাজদের চোখমুখ দেখে আমার ভালো ঠেকছে না।”
হঠাৎ করেই লোকজনের ভীড়ের মধ্যে নানের পোশাকে একজনকে দেখতে পেলো ভ্যালেন্টাইন। গাড়ির জানালা দিয়ে হাত নেড়ে তার মনোযোগ পাবার চেষ্টা করলো সে। বৃদ্ধ নান তাকে দেখতে পেয়ে হাত নাড়লেও লোকজনের ভীড় ঠেলে এগোতে পারলো না।
“ভ্যালেন্টাইন, না!” দরজা খুলে তার বোন লাফ দিয়ে পথে নেমে গেলে মিরিয়ে চিৎকার করে বললো।
মঁসিয়ে, প্লিজ,” গাড়ি থেকে নেমে অনুনয় করে ড্রাইভারকে বললো মিরিয়ে, আপনি কি গাড়িটা একটু রাখবেন? আমার বোন খুব জলদিই ফিরে আসবে।” লোকজনের ভীড় ঠেলে ভ্যালেন্টাইনকে চলে যেতে দেখছে সে। উদভ্রান্তের মতো সিস্টার কুদের কাছে যাবার চেষ্টা করছে মেয়েটা।
“মাদেমোয়ে,” ড্রাইভার বললো, “আমি নীচে নেমে ঘোড়াগুলো হাতে টেনে গাড়িটা ঘোরাচ্ছি। এখানে ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে আছি আমরা। যেসব গাড়ি তারা থামিয়েছে সেগুলোতে বন্দী আছে।”
“আমরা একজনের সাথে দেখা করতে এসেছি,” মিরিয়ে বললো। “এক্ষুণি তাকে এখানে নিয়ে আসবো, তারপরই চলে যাবো এখান থেকে। মঁসিয়ে, আমি আপনার কাছে আবারো অনুনয় করছি, একটু অপেক্ষা করুন।”
“এইসব বন্দীদের, চারপাশে ঘিরে থাকা কয়েকটি গাড়ির দিকে চেয়ে বললো ড্রাইভার, “সবাই পাদ্রী আর যাজক, তারা রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য দেখায় নি বলে ধরে আনা হয়েছে। আমি তাদেরকে নিয়ে যেমন আশংকা করছি তেমনি আমাদের নিরাপত্তা নিয়েও শংকিত। আমি গাড়িটা ঘোরাচ্ছি, এই ফাঁকে আপনার বোনকে নিয়ে চলে আসুন। সময় নষ্ট করবেন না।”
ড্রাইভার সিট থেকে নেমে ঘোড়াগুলো ঘোরাতে শুরু করলে মিরিয়ে। লোকজনের ভীড় ঠেলে এগোনোর চেষ্টা করলো। তার বুক ধকধক করছে এখন।
চারপাশে জনসমুদ্র। লোকজনের ভীড়ের কারণে ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে পাচ্ছে না। বহু কষ্টে সামনে এগোতে গিয়ে তার কাছে মনে হলো অসংখ্য হাত তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে অন্য দিকে। মানুষের কাঁচা মাংসের গন্ধ নাকে এসে লাগতেই ভয়ে তার গলা শুকিয়ে এলো।
হঠাৎ লোকজনের ভীড়ের ফাঁকে ভ্যালেন্টাইনকে এক ঝলক দেখতে পেলো মিরিয়ে। সিস্টার ক্লদের থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে আছে সে। হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধ নানকে ধরার চেষ্টা করছে। এরপরই লোকজনের ভীড়টা আরো গাঢ় হয়ে। গেলে হারিয়ে ফেললো তাকে।
“ভ্যালেন্টাইন!” চিৎকার করে ডাকলো মিরিয়ে। কিন্তু হাজার হাজার লোকের বজ্রকণ্ঠের কাছে মিইয়ে গেলো সেটা। লোকজনের ভীড় ঠেলতে ঠেলতে বন্দীদের গাড়িগুলোর সামনে নিয়ে গেলো তাকে। এইসব গাড়িতেই পাদ্রীরা আছে।
ভ্যালেন্টাইনের দিকে ছুটে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করলো মিরিয়ে কিন্তু উন্মাতাল জনসমুদ্রের স্রোত তাকে সরিয়ে দিচ্ছে ক্রমশ। আস্তে আস্তে সে বন্দীদের গাড়ির দিকে চলে এলো। তাকে একটা গাড়ির সাথে সাঁটিয়ে দিলো জনসমুদ্র। ঠিক তখনই খুলে গেলো গাড়িটার দরজা।
দাঙ্গাবাজ লোকগুলো বন্দীদের টেনে হিঁচড়ে বের করে আনতে শুরু করলো এবার। ভয়ার্ত এক যুবকপাদ্রীর সাথে মিরিয়ের চোখাচোখি হয়ে গেলো কিছু সময়ের জন্যে। তারপরই তাকে টেনে নিয়ে গেলো হিংস্র মানুষগুলো। এক বৃদ্ধ যাজক দরজা দিয়ে লাফিয়ে নীচে নেমে এসে হাতের লাঠিটা দিয়ে আঘাত করতে শুরু করলো দাঙ্গাকারীদের। উদভ্রান্তের মতো চিৎকার করে জেলখানার রক্ষিদের ডাকলো সাহায্যের জন্যে কিন্তু তারাও এখন হিংস্র পশু হয়ে গেছে, দাঙ্গাকারী খুনে লোকগুলোর সাথে যোগ দিয়ে পাদ্রীদের ছিন্নভিন্ন করে ফেললো মুহূর্তে। পায়ের নীচে ফেলে পিষ্ট করে ফেললো অনেককে।
একটা ঘোড়াগাড়ির চাকা ধরে মিরিয়ে দেখতে লাগলো একের পর এক পাদ্রীকে টেনে হিঁচড়ে গাড়ি থেকে বের করে হিংস্র লোকগুলো পশুর মতো হামলে পড়ছে। শাবল-গাইতি, লাঠিসোটা, যার কাছে যা আছে তা নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ছে বিচারের জন্যে আনা পাদ্রীদের উপর। সুতীব ভয়ে বার বার ভ্যালেন্টাইনের নাম ধরে ডাকতে লাগলো মিরিয়ে। কিন্তু সবই বৃথা। এক সময় জনসমুদ্রের ঢেউ তাকে ধাক্কা মেরে গাড়ির কাছ থেকে সরিয়ে জেলখানার দেয়ালের দিকে নিয়ে গেলো।