দুপুর : ১টা
প্যারিস কমিউনের ভেতরে কাঠের একটি বেঞ্চে বসে আছে জার্মেইন দ্য স্তায়েল। প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে এখানে বসে আছে সে। তার চারপাশে ছোটো ছোটো দলে বিভক্ত হয়ে অসংখ্য লোকজন থাকলেও তারা কোনো কথা বলছে না। কিছু লোক তার পাশে বসে থাকলেও বেশিরভাগ লোক বসে আছে ঘরের মেঝেতে। পাশের একটা খোলা দরজা দিয়ে স্তায়েল দেখতে পাচ্ছে লোকজন স্ট্যাম্প মারা কাগজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। মাঝেমধ্যেই তারা ঘরে এসে কাগজ দেখে দেখে লোকজনের নাম ধরে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে ভেতরে। যাদের নাম ধরে ডাকা হচ্ছে তাদের মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। বাকিরা তালি বাজিয়ে সাহস যোগাচ্ছে তাদেরকে।
মাদাম স্তায়েল অবশ্য জানে দরজার ওপাশে কি হচ্ছে। প্যারিস কমিউনের সদস্যরা দ্রুত এবং তাৎক্ষণিক বিচার করছে অপরাধীদের। অপরাধ বলতে বংশগত অবস্থান এবং রাজার প্রতি আনুগত্য থাকা। অভিজাত বংশের হলে তার রক্ত প্যারিসের পথেঘাটে রঞ্জিত হবে আগামীকাল সকালে। জার্মেইন নিজের পরিচয় কোনোভাবেই লুকাতে পারবে না। সেই সুযোগ তার নেই। বেঁচে থাকার একমাত্র আশা : হয়তো বিচারকেরা গর্ভবতী কোনো মহিলাকে গিলোটিনে শিরোচ্ছেদ করবে না।
জার্মেইন যখন অপেক্ষা করছে তখন হঠাৎ করে তার পাশে বসা এক লোক কাঁদতে কাঁদতে খিচুনি দিতে লাগলো। ঘরের বাকিরা কেউ এগিয়ে এসে লোকটাকে সান্ত্বনা দিলো না বরং এমনভাবে তার দিকে তাকালো ঠিক যেভাবে নোংরা কদর্য ভিক্ষুকদের দিকে উন্নাসিক ধনীরা তাকায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জার্মেইন উঠে দাঁড়ালো। এরকম লোকের সাথে একই বেঞ্চে বসে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাকে এখন মাথা খাটাতে হবে নিজেকে রক্ষা করার একটা উপায় বের করার জন্য।
ঠিক এ সময় তার চোখে পড়লো জনাকীর্ণ ঘরে লোকজনের ভীড় ঠেলে হাতে একগাদা কাগজ নিয়ে এক যুবক পাশের ঘরে যাচ্ছে। জার্মেইন চিনতে পারলো তাকে।
“কামিয়ে!” চিৎকার করে ডাকলো সে। “কামিয়ে দেমোলা!” যুবকটি তার। দিকে ফিরে তাকাতেই অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। কামিয়ে দেয়োল প্যারিসের একজন প্রসিদ্ধ নাগরিক। তিন বছর আগে একজন জেসুইট ছাত্র হিসেবে অধ্যয়নরত ছিলো, তো জুলাই মাসের এক উত্তপ্ত রাতে ক্যাফে ফোয়ে এসে উপস্থিত লোকজনকে বাস্তিল দূর্গ আক্রমণ করার প্রস্তাব করেছিলো সে। এখন। ফরাসি বিপ্লবের একজন নায়ক বনে গেছে কামিয়ে।
“মাদাম দ্য স্তায়েল!” ভীড় ঠেলে তার হাতটা ধরে বললো সে। “আপনি এখানে কেন? নিশ্চয় রাষ্ট্রদ্রোহী কোনো কাজ করেন নি?” এমন মিষ্টি করে হেসে কথাটা বললো যে এই অন্ধকারাচ্ছন্ন মৃত্যুপরীতে সেটা একদমই বেমানান। জার্মেইনও চেষ্টা করলো মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার।
“প্যারিসের মহিলা নাগরিকেরা আমাকে ধরে এনেছে এখানে,” একটু কূটনৈতিক ভাষা ব্যবহার করে বললো সে। মনে হচ্ছে অ্যাম্বাসেডরের স্ত্রীর শহরের গেট দিয়ে বের হয়ে যাওয়াটা এখন রাষ্ট্রদ্রোহ কাজ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আমরা যখন মুক্তি আর স্বাধীনতার জন্যে কঠিন সংগ্রাম করছি তখন এটা কি পরিহাসের ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে না আপনার কাছে?”
কামিয়ের মুখ থেকে হাসি উবে গেলো। জার্মেইনের পাশে বেঞ্চে বসা লোকটার দিকে আড়চোখে তাকালো সে। তারপর জার্মেইনের হাত ধরে একটু পাশে সরিয়ে নিলো তাকে।
“আপনি বলতে চাচ্ছেন কোনো রকম পাস আর এসকর্ট ছাড়া আপনি প্যারিস ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন? হায় ঈশ্বর, এ কি করেছেন মাদাম। আপনার ভাগ্য ভালো তাৎক্ষণিক বিচারে আপনাকে গুলি করে মারা হয় নি!”
“কী যা তা বলছেন!” আৎকে উঠে বললো সে। “আমার তো কূটনৈতিক সুরক্ষা আছে। আমাকে জেলে ভরলে সেটা সুইডেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল বলে বিবেচিত হবে। আমাকে যে এখানে আটকে রাখা হয়েছে এটা শুনলেই তারা ভীষণ ক্ষেপে যাবে।” তার এই ক্ষণস্থায়ী সাহসিকতা কামিয়ের পরের কথাগুলো শুনে পুরোপুরি লোপ পেয়ে গেলো।
“এখন কি হচ্ছে সেটা কি আপনি জানেন না? আমরা এখন যুদ্ধাবস্থায় আছি, বহিশত্রুর আক্রমণের মুখোমুখি…” কথাগুলো একটু চাপাকণ্ঠে বললো যাতে আশেপাশের কেউ শুনতে না পায়। কারণ এই খবরটা এখনও জনগণ জানতে পারে নি, জানতে পারলে একটা আতঙ্ক আর ভীতি ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র। “ভারদানের পতন হয়েছে,” বললো সে।
স্থিরচোখে চেয়ে রইলো জার্মেইন। খুব দ্রুতই বুঝতে পারলো তার অবস্থা কতোটা সঙ্গিন এখন। ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো, “অসম্ভব! তারপর মাথা দুলিয়ে জানতে চাইলো, “প্যারিস থেকে কতো দূরে আছে…মানে তারা এখন কোথায় আছে?”
“আমার ধারণা দশ ঘণ্টারও কম সময়ে তারা প্যারিসে পৌঁছে যাবে। এরইমধ্যে একটা আদেশ জারি করা হয়েছে, শহরের প্রবেশদ্বার দিয়ে যে বা যারাই ঢোকার চেষ্টা করবে তাদেরকে যেনো গুলি করা হয়। আর এ মুহূর্তে যান দেশ ছাড়ার চেষ্টা করবে তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিবেচনা করা হবে। জার্মেইনের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকালো সে।
“কামিয়ে,” জার্মেইন বললো। “আপনি কি জানেন আমি কেন সুইজারল্যান্ডে আমার পরিবারের সাথে যোগ দিতে এতোটা মরিয়া? আমি যদি আরো দেরি কবি তাহলে হয়তো আর ওখানে যেতেই পারবো না। আমি গর্ভবতী।”
কামিয়ে অবিশ্বাসের সাথে তাকালো তার দিকে, তবে জার্মেইনের সাহস আবার ফিরে এসেছে। যুবকের হাতটা নিয়ে নিজের পেটের উপর রাখলো সে। কামিয়ে বুঝতে পারলো কথাটা মিথ্যে নয়। প্রসন্ন হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে।