“আগস্টের তেইশ তারিখে লঙ্গাই দূর্গটি শত্রুবাহিনী দখল করে নিয়েছে। প্রুশিয়ান সেনাবাহিনীর কমান্ডার ব্রুন্সউইকের ডিউক এক আদেশ জারি করেছে, আমরা যেনো অতি শীঘ্রই রাজাকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে রাজপরিবারকে পূণরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করি। তা না হলে তার সৈন্যেরা প্যারিসকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে!”
ঘরের হৈহল্লায় সেক্রেটারির কথা ছাপিয়ে যাচ্ছে বার বার। এরইমধ্যে তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন নিজের কথা সবার কাছে পৌঁছে দেবার জন্যে।
অ্যাসেম্বলি ফ্রান্সের উপর তার ভঙ্গুর কর্তৃত্ব বহাল রেখেছে রাজাকে বন্দী করে রাখার পর থেকেই। কিন্তু ব্রুন্সউইকের আদেশমতে যোড়শ লুইকে ছেড়ে দেয়াটা আসলে ফ্রান্স আক্রমণ করার একটি অজুহাত মাত্র। ক্রমবর্ধমান ঋণগ্রস্ততা আর বাহিনী থেকে ব্যাপকহারে চলে যাওয়ার কারণে ফরাসি সেনাবাহিনী এতোটাই দূর্বল আর নাজুক যে কিছু দিন আগে ক্ষমতায় আসা নতুন। ফরাসি সরকার যেকোনো দিন পতন হয়ে যাবার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো ব্যাপার হলো, অ্যাসেম্বলির ডেলিগেটরা একে অন্যেকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছে। মনে করছে সীমান্তে যে শত্রু জড়ো হয়েছে তাদের সাথে তলে তলে হাত মেলাচ্ছে অনেকেই। নিজের আসনে বসে থেকে ডেভিড ভাবছেন, এটাই হলো এই অরাজকতার আসল কারণ।
“নাগরিকগণ!” চিৎকার করে বললেন সেক্রেটারি। “আমি আপনাদেরকে ভয়ঙ্কর একটি সংবাদ দিচ্ছি। আজ সকালে ভারদানের দূর্গটাও প্রুশিয়ানদের দখলে চলে গেছে। আমাদের সবাইকে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র-”
পুরো অ্যাসেম্বলিতে যেনো উন্মাদনা শুরু হয়ে গেলো। ভয়ার্ত ইঁদুরের মতো লোকজন এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগলো উদভ্রান্ত হয়ে। শত্রুবাহিনী আর প্যারিসের মাঝখানে ভারদানের দূর্গটি তাদের সর্বশেষ শক্তঘাঁটি! হয়তো রাতের মধ্যেই প্রশিয়ান সেনাবাহিনী চলে আসবে প্যারিসে।
চুপচাপ বসে থেকে ডেভিড কথাগুলো শোনার চেষ্টা করে গেলেন। হট্টগোলের কারণে সেক্রেটারির কথা একদমই শোনা যাচ্ছে না এখন। লোকজনের ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকালেন তিনি।
পুরো অ্যাসেম্বলিটা উন্মাদগ্রস্ত লোকজনের আখড়ায় পরিণত হয়ে গেছে। উপর থেকে বিক্ষুব্ধ আর উশৃঙ্খল লোকজন মডারেটদের উপর কাগজ আর ফলমূল ফেলছে। এইসব গায়রোদিনরা ক’দিন আগেও লিবারেল হিসেবে পরিচিত ছিলো, ভয়ার্ত ফ্যাকাশে মুখে অসহায়ের মতো উপরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে যাচ্ছে এখন। তারা পরিচিত রিপাবলিকান রয়্যালিস্ট হিসেবে, যারা তিন তিনটি জিনিসের সমর্থক : অভিজাত পরিবার, যাজকতন্ত্র এবং বুর্জোয়া। ব্রুনসউইকের আদেশের কারণে এই অ্যাসেম্বলি রুমেও তাদের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছে। এটা তারাও ভালো করে জানে।
প্রুশিয়ান সেনাবাহিনী প্যারিসে আসার আগেই রাজতন্ত্রের পুণর্বহাল যারা সমর্থন করে তারা সবাই হয়তো মারা যাবে।
এবার সেক্রেটারি পোডিয়াম থেকে নেমে যেতেই সেখানে এসে দাঁড়ালেন দাঁতোয়াঁ, যাকে সবাই অ্যাসেম্বলির সিংহ বলে ডাকে। বিশাল মাথা আর সুগঠিত শরীর তার, শৈশবে ষাড়ের সাথে লড়াই করতে গিয়ে নাকে-ঠোঁটে আঘাত পেয়েছিলেন। সেই ক্ষত এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন। নিজের ভারি দু’হাত তুলে সবাইকে শান্ত হতে বললেন তিনি।
“নাগরিকগণ! মুক্ত দেশের একজন মন্ত্রী হয়ে এ কথাটা বলতে সন্তোষ বোধ করছি যে, তাদের দেশ রক্ষা পেয়ে গেছে। কারণ সবাই সজাগ, সবাই প্রস্তুত, এই লড়াইয়ে যোগ দিতে সবাই উন্মুখ হয়ে আছে…”
শক্তিশালী এই নেতার কথা শুনে পুরো ঘরের মধ্যে আস্তে আস্তে নীরবতা নেমে আসতে শুরু করলো। দাঁতোয় তাদেরকে আগুয়ান হয়ে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে বললেন, দুর্বলদের মতো পিছুটান না দিয়ে প্যারিসে যে ঝড় ধেয়ে আসছে বুক চিতিয়ে সেটার প্রতিরোধ করতে আহ্বান জানালেন। শহরের প্রতিটি নাগরিক যেনো অস্ত্র ধারণ করে, যার যা আছে তাই নিয়ে যেনো প্রহরা দেয় প্রতিটি প্রবেশদ্বার। তার এমন জ্বলাময়ী বক্তব্য শুনে সবাই উদ্দীপ্ত হলো, উৎফুল্ল হয়ে আনন্দ ধ্বনি প্রকাশ করলো সমস্বরে।
“আমরা যে চিৎকার করছি সেটা বিপদের ভয়ে আর্তচিৎকার নয়, ফ্রান্সের শত্রুদের বিরুদ্ধে আমাদের হুঙ্কার!…আমাদেরকে দেখিয়ে দিতে হবে, আবারো দেখিয়ে দিতে হবে, সব সময় আমরা যেমনটি দেখিয়ে দিয়েছি-ফ্রান্স টিকে থাকবে…ফ্রান্স রক্ষা পাবেই!”
পুরো অ্যাসেম্বলিতে উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়লো। হাতের সামনে যা কিছু পেলো, সব শূন্যে ছুঁড়ে মেরে চিৎকার করে বলতে লাগলো সবাই : “লদেসি! লদেসি! দেখিয়ে দাও! দেখিয়ে দাও!”
এই হট্টগোলের মধ্যে ডেভিডের চোখ গ্যালারিতে বসা এক লোকের উপর নিবদ্ধ হলো। হালকা পাতলা গড়নের ধবধবে সাদা একজন মানুষ, গায়ের পোশাক একেবারে পরিপাটী, মাথার উইগে বেশ সুন্দর করে পাউডার দেয়া। হিম-শীতল সবুজ দৃষ্টির এক যুবক, সাপের মতোই চকচক করে তার চোখ দুটো।
ডেভিড দেখলেন, এই যুবক দাঁতোয়াঁর উজ্জীবিত বক্তৃতায় মোটেও আলোড়িত হচ্ছে না, চুপচাপ বসে আছে। তাকে দেখেই ডেভিড বুঝতে পারলেন, অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া, হাজারো সমস্যায় জর্জরিত, নিজেদের মধ্যে বিবাদ আর আশেপাশের ডজনখানেক শত্রুদেশের হাত থেকে একটা জিনিসই কেবল ফ্রান্সকে রক্ষা করতে পারে আর সেটা দাঁতোয়াঁ কিংবা মারাতের জ্বালাময়ী বক্তৃতা নয়। ফ্রান্সের দরকার একজন নেতার। এমন একজন নেতা যার শক্তি নিহিত আছে স্তব্ধতার মাঝে। যে গলাবাজি করে না, কিন্তু প্রয়োজনে নিজের ক্ষমতা দেখাতে পারে। এমন একজন নেতা যার পাতলা ঠোঁটে লোভ আর সম্মানের চেয়ে ‘সততা’ শব্দটিই বেশি সুমধুর শোনায়। যে জঁ জ্যাক করে। মতাদর্শকে সন্নত রাখতে পারবে, এই মতাদর্শের উপরেই তো তাদের বিপ্লব সূচীত হয়েছে। গ্যালারিতে চুপচাপ বসে আছে যে লোকটা সে-ই হলো সেই নেতা। তার নাম ম্যাক্সিমিলিয়ে রোবসপাইয়ে।