“আমি ওখানে একা একা যেতে মোটেও ভয় পাচ্ছি না,” বললো ভ্যালেন্টাইন। “অ্যাবিসের কাছে আমি প্রতীজ্ঞা করেছিলাম যেকোনো দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকবো। এখন সময় এসেছে নিজের কথা রাখার। তবে তুমি এখানেই থাকো, বোন। আঙ্কেল জ্যাক-লুই তার অনুপস্থিতিতে আমাদেরকে বাড়ির বাইরে যেতে বারণ করে দিয়েছেন।”
“তাহলে আমাদেরকে খুব বুদ্ধিখাঁটিয়ে বের হতে হবে,” জবাব দিলো মিরিয়ে। কারণ তোমাকে একা একা কর্নেলিয়ায় যেতে দেবো না আমি। এটা তুমি জেনে রেখো।”
সকাল ১০টা
সুইডিশ অ্যাম্বাসির গেট দিয়ে জার্মেইন দ্য স্তায়েলের ঘোড়ার গাড়িটা বের হয়ে গেলো। গাড়ির ছাদের উপরে কতোগুলো ট্রাঙ্ক আর উইগবক্স থরে থরে বেধে রাখা হয়েছে। দু’জন কোচোয়ান আর নিজস্ব চাকর রয়েছে তার সাথে। গাড়ির ভেতরে রয়েছে জার্মেইনের কাজের মহিলা আর অসংখ্য গহনার কেস। পরে আছে অ্যাম্বাসেডরের পোশাক। প্যারিসের রাস্তা দিয়ে তার ছ’টি সাদা ধবধবে ঘোড়া ধুলো উড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে শহরের প্রবেশদ্বারের অভিমুখে। গাড়ির দরজায় সুইডিশ রাজের রঙ্গিন ক্রেস্ট লাগানো। জানালার পর্দাগুলো নামিয়ে রাখা হয়েছে।
নিজের ভাবনায় ডুবে থাকা জার্মেইন আবদ্ধ গাড়ির ভেতরে প্রচণ্ড গরম থাকা সত্ত্বেও জানালা দিয়ে মুক্ত বাতাস নিচ্ছে না। তবে প্রবেশদ্বারের সামনে গাড়িটা আচমকা ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেলে জার্মেইন জানালা খুলে বাইরে তাকালো।
বাইরে কিছু বিক্ষুব্ধ মহিলা শাবল আর গাইতি নিয়ে তেড়ে আসছে তাদের দিকে। কয়েকজন জার্মেইনের দিকে সংক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকালো। তাদের ভীতিকর মুখগুলো এবড়োথেবড়ো, বেশ কয়েক পাটী দাঁত নেই। উশৃঙ্খল লোকজনের মুখ সব সময় এরকম বিশ্রি হয়ে কেন? ভাবলো জার্মেইন। জানালা দিয়ে মুখটা বের করলো সে।
“এখানে হচ্ছেটা কি?” বেশ কর্তৃত্বের সুরে বললো। “এক্ষুণি আমার গাড়ির সামনে থেকে সরে দাঁড়াও!”
“কাউকে শহর ছাড়ার অনুমতি দেয়া হয় নি!” জনসমাগমটি দ্রুত বেড়ে গেলে তাদের মধ্যে থেকে বেশ কয়েকজন সমস্বরে বললো।
“আমি সুইডিশ অ্যাম্বাসেডর!” চিৎকার করে বললো জার্মেইন। একটা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাজে সুইজারল্যান্ডে যাচ্ছি! আমি আদেশ করছি, এক্ষুণি আমার পথ থেকে সরে দাঁড়াও!”
“হা! আমাদেরকে আদেশ করে!” জানালার সামনে থাকা বিক্ষুব্ধ এক মহিলা চেঁচিয়ে বললো। একদলা থুতু ছুঁড়ে মারলো সে, সঙ্গে সঙ্গে উল্লাস প্রকাশ করতে শুরু করলো সবাই।
একটা রুমালে মুখটা মুছে নিয়ে সেটা জানালার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে চিৎকার করে বললো জার্মেইন, “এই নাও তোমাদের প্রাণপ্রিয় শ্রদ্ধেয় অর্থমন্ত্রি জ্যাক নেকারের মেয়ের রুমাল। এই থুতু তোমাদের মুখে মাখো!…জানোয়ারের দল কোথাকার।” গাড়ির ভেতরে তার কাজের মহিলাদের দিকে তাকালো। তারা ভয়ে জড়োসরো হয়ে আছে। এই ঘটনার নাটের গুরু কে সেটা আমরা দেখে : নেবো।”
কিন্তু ততোক্ষণে বিক্ষুব্ধ মহিলারা গাড়ি থেকে ছ’টি ঘোড়া খুলে নিয়ে সরিয়ে ফেলেছে। আরেকটি দল গাড়িটাকে টানতে টানতে প্রবেশদ্বার থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অন্য কোথাও। যেনো একদল পিঁপড়ে কেকের টুকরো বয়ে চলেছে।
আতঙ্কগ্রস্ত জার্মেইন শক্ত করে দরজা ধরে রাখলো। জানালা দিয়ে চিৎকার করে অভিশাপ আর হুমকি-ধামকি দিতে লাগলো জনতাকে। কিন্তু বাইরের বিক্ষুব্ধ জনতার হৈহায় ধামাচাপা পড়ে গেলো সেটা। কিছুক্ষণ পরই রক্ষিবেষ্টিত বিশাল একটি ভবনের সামনে গাড়িটা থেমে গেলে জার্মেইন যা দেখতে পেলো তাতে করে তার রক্ত জমে বরফ হবার জোগার। তারা তাকে হোটেল দ্য ভিলে’তে নিয়ে এসেছে। প্যারিস কমিউনের হেডকোয়ার্টার এটি।
তার গাড়ির চারপাশে যে উশৃখল জনতা আছে তাদের চেয়ে প্যারিস কমিউন অনেক বেশি বিপজ্জনক। উন্মাদ একদল লোকের সমাহার। এমন কি অ্যাসেম্বলির অনেক সদস্য তাদেরকে যমের মতো ভয় পায়। প্যারিসের রাস্তাঘাট থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি তারা, অভিজাত পরিবারের লোকজনদেরকে জেলে পুরে বিচার করে, দ্রুত কার্যকর করে তাদের মৃত্যুদণ্ড যা কিনা স্বাধীনতা-মুক্তির যে ধারণা দেয়া হচ্ছে তার একেবারেই বিপরীত চিত্র। তাদের কাছে জার্মেইন দ্য স্তায়েল হলো আরেকজন অভিজাত ব্যক্তি যার গদান কেটে ফেলা উচিত। সে নিজেও এটা জানে।
গাড়ির দরজা জোর করে খুলে জার্মেইনকে টেনে হিঁচড়ে নীচে নামালো ক্রুব্ধ মহিলারা। শীতল চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে দৃঢ়ভাবে সোজা হয়ে হেঁটে গেলো সে সামনের দিকে। তার পেছনে তার চাকরেরা ভয়ে আর্তনাদ করছে, তাদেরকে লাঠিসোটা দিয়ে পেটানো হচ্ছে। দু’পাশ থেকে মহিলারা টেনে টেনে হোটেল দ্য ভিলের সিঁড়িতে নিয়ে গেলো জার্মেইনকে। আচমকা তার সামনে এসে দাঁড়ালো এক লোক। হাতের চাকুটা দিয়ে তার গাউনের বাধন কেটে দিলে সেটা খুলে পড়তে উদ্যত হলো। কোনোরকম গাউনটা শরীরের সাথে জড়িয়ে রাখলো সে। এক পুলিশ সামনে চলে এলে দম বন্ধ হয়ে গেলো জার্মেইনের। লোকটা তাকে জড়িয়ে ধরে দ্রুত অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবনের ভেতরে চলে গেলো।
সকাল : ১১টা
ডেভিড হাপাতে হাপাতে অ্যাসেম্বলিতে এসে পৌঁছালেন। বিশাল ঘরটা লোকে লোকারণ্য, চিৎকার চেঁচামেচি চলছে। মাঝখানের পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে আছেন সেক্রেটারি সাহেব। চিৎকার করে নিজের কথা পৌঁছে দিতে চাচ্ছেন সবার কাছে। লোকজনের ভীড় ঠেলে নিজের সিটের দিকে এগোনোর সময় ডেভিড বুঝতেই পারলেন না সেক্রেটারি কী বলছেন।