“আপনি ঐসব জার্নালে কি পেলেন, সেগুলো এখন কোথায় আছে?” আমি তাড়া দিলাম তাকে।
“ওগুলো এখনও আমার কাছেই আছে। আমি যখন জেলে তখন আমার। পৃষ্ঠপোষক কোনো উত্তরাধিকার না রেখেই মারা যায়। ঐতিহাসিক মূল্য ছিলো বলে ওগুলোর আর্থিক মূল্যও ছিলো অনেক। কিন্তু সাদা চোখে ওগুলো পাগলের প্রলাপ আর কুসংস্কার ছাড়া কিছু ছিলো না। ডাইনীবিদ্যা আর জাদুমন্ত্র।”
“আমার মনে হয় আপনি ওগুলোকে পাণ্ডিত্যপূর্ণও বলেছিলেন একটু আগে?”
“হ্যাঁ। একজন যাজকের যা বিদ্যাবুদ্ধি থাকার কথা সেদিক থেকে বিবেচনা করলে পাণ্ডিত্যপূর্ণই ছিলো বলা চলে। বুঝলে, কার্ডিনাল রিশেলু যখন সমগ্র ইউরোপের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় নি তখন একটা কাজে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলো, আর সেটা হলো শক্তি নিয়ে স্টাডি করা। তার সমস্ত স্টাডির কেন্দ্রে ছিলো একটা জিনিস-সম্ভবত তুমি মন্তগ্লেইন সার্ভিসের নাম শুনেছে, শোনন নি?”
“শার্লেমেইনের দাবাবোর্ডের কথা বলছেন?” নিজের কণ্ঠ যতোটা সম্ভব শান্ত রেখে বললাম আমি, যদিও আমার হৃদস্পন্দন ঘোড়ার মতো ছুটছিলো তখন। তার দিকে ঝুঁকে আস্তে আস্তে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম যেনো উত্তেজিত হয়ে আবার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ না হয়ে যায়। মন্তগ্লেইন সার্ভিস সম্পর্কে আমার জানা দরকার। কিন্তু জিনিসটা শত শত বছর আগে হারিয়ে গেছে। আমি শুধু জানি এর অকল্পনীয় মূল্য রয়েছে।
“আমি তো মনে করতাম ওটা নিছক কোনো কিংবদন্তী,” বললাম তাকে।
“কিন্তু রিশেলু সেটা মনে করতো না,” বৃদ্ধ দার্শনিক জবাব দিলেন। “এই জিনিসটার উৎপত্তি আর গুরুত্ব সম্পর্কে ভদ্রলোক বারোশ’ পৃষ্ঠার গবেষণাধর্মী জানাল লিখে গেছে। এজন্যে আচেন অথবা আয়-লা-শ্যাপিয়ে তেও ভ্রমণ করেছে সে। এমন কি মন্তগ্লেইনেও তদন্ত করেছে, কারণ তার বিশ্বাস ছিলো ওটা। ওখানেই কোথাও মাটির নীচে লুকিয়ে রাখা আছে। তবে সে সফল হতে পারে নি। বুঝলে, আমাদের কার্ডিনাল মনে করতো এই সার্ভিসটায় রয়েছে রহস্যের। চাবি, দাবার চেয়েও পুরনো কোনো রহস্য, সম্ভবত মানবসভ্যতার সমবয়সী কোনো রহস্য। এমন একটা রহস্য যা ব্যাখ্যা করতে পারবে সভ্যতার উত্থান আর পতনকে।”
“এটা কি ধরণের রহস্য হতে পারে?” নিজের উত্তেজনা আবারো লুকিয়ে রেখে জানতে চাইলাম।
“আমি তোমাকে বলবো সে কি ভাবতো,” বললেন ভলতেয়ার। “যদিও সে ধাঁধাটার সমাধান করার আগেই মারা যায়। এ থেকে তুমি নিজে নিজে বুঝে নিও, কিন্তু এরপর এই ব্যাপরটা নিয়ে আমাকে কোনো প্রশ্নটশ্ন করতে পারবে না। কার্ডিনাল রিশেলু বিশ্বাস করতো মন্তগ্লেইন সার্ভিসে একটি ফর্মুলা রয়েছে। দাবাবোর্ডটির বিভিন্ন অংশে সেই ফর্মুলা লুকিয়ে রাখা হয়েছে। ঐ ফর্মুলাটি প্রকাশ করে এক মহাজাগতিক শক্তির সিক্রেটকে…”
.
তয়িরাঁ মরিস তার গল্প বলা থামিয়ে মৃদু আলোর মধ্য দিয়ে ভ্যালেন্টাইন আর। মিরিয়ের দিকে তাকালো। বিছানার চাদরের নীচে গুটিশুটি মেরে শুয়ে তার গল্প শুনে যাচ্ছে দু’বোন। ঘুমিয়ে পড়ার ভান করছে। মরিস উঠে দাঁড়ালো, তাদের গা থেকে চাদরটা সরিয়ে দিলো এক ঝটকায়। আলতো করে মেয়ে দুটোর চলে হাত বুলালো সে।
“আঙ্কেল মরিস,” চোখ খুলে বললো মিরিয়ে, “আপনি তো আপনার গল্পটা শেষ করলেন না। কার্ডিনাল রিশেলু কোন্ ফর্মুলাটা সারা জীবন ধরে খুঁজে ফিরেছেন? মন্তগ্লেইন সার্ভিসের বিভিন্ন অংশে কি লুকিয়ে আছে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন?”
“এই জিনিসটাই আমরা একসাথে আবিষ্কার করবো, ডার্লিং।” তয়িরাঁ মুচকি হেসে বললো। এবার চোখ খুলে ফেললো ভ্যালেন্টাইন। রীতিমতো কাঁপতে শুরু করলো মেয়ে দুটো।
“আমি কখনও ঐ পাণ্ডুলিপিটা দেখি নি। আমার সাথে কথা হবার কিছু দিন। পরই ভলতেয়ার মারা যান। তার সমস্ত লাইব্রেরিটা এমন একজন কিনে নেয় যিনি কার্ডিনাল রিশেলুর জানাল সম্পর্কে বেশ ভালোই অবগত ছিলেন। তিনি মহাজাগতিক শক্তিটা কি সেটা বোঝেন এবং এরজন্যে লালায়িতও বটে।”
“এই মানুষটি আমাকে এবং মিরাবুকে ঘুষ দেবার চেষ্টা করেছিলেন, যিনি বিল অব সিজার অ্যাসেম্বলিতে পাস বার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, যাতে করে মন্তগ্লেইন সার্ভিসটা রাষ্ট্র অধিগ্রহণ করতে পারে, কোনো উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এবং নীতিহীন কেউ হস্তগত করতে না পারে।”
“কিন্তু আপনি তো ঘুষ নেন নি, আঙ্কেল মরিস?” বিছানায় উঠে বসে বললো ভ্যালেন্টাইন।
“ঐ ক্রেতা অর্থাৎ মহিলার কাছে আমার মূল্য একটু বেশিই ছিলো বলতে পারো!” হেসে বললো তয়িরাঁ মরিস। কারণ আমি নিজেই সার্ভিসটা চাই। এখনও সেটা খুঁজে বেড়াচ্ছি।”
ভ্যালেন্টাইনের দিকে নিভু নিভু মোমবাতির আলোয় তাকিয়ে মুচকি হেসে আরো বললো, “তোমাদের অ্যাবিস মারাত্মক একটি ভুল করে ফেলেছে…মানে সে যা করেছে তা যদি বিবেচনা করে দেখো। মহিলা অ্যাবি থেকে সার্ভিসটা সরিয়ে ফেলেছে। আহ, আমার দিকে ওভাবে তাকিও না, মাই ডিয়ার। এটা কাকতালীয় ব্যাপার বলে মনে হতে পারে, তাই নয় কি, কারণ তোমাদের আঙ্কেলের মতে মহিলা চলে গেছেন রাশিয়ায়। বুঝলে, যে মহিলা ভলতেয়ারের লাইব্রেরিটা কিনে নিয়েছেন, আমাকে আর মিরাবুকে ঘুষ দিতে চেয়েছেন, যিনি বিগত চল্লিশ বছর ধরে মন্তগ্লেইন সার্ভিসটা খুঁজে বেড়াচ্ছেন হন্যে হয়ে তিনি আর কেউ নন, সমগ্র রাশিয়ার সম্রাজ্ঞি ক্যাথারিন দি গ্রেট।”
বিসর্জন
খাদের কিনারায় বসেও লোকে দাবা খেলতে পরোয়া করে না।