ভলতেয়ার তখন স্বেচ্ছা-নিবাসন থেকে ফিরে এসেছেন প্যারিসে। নতুন একটি নাটক মঞ্চায়নের কাজেও হাত দিয়েছেন তখন। তবে সবাই বিশ্বাস করতো তিনি নিজ শহরে ফিরে এসেছেন মৃত্যুবরণ করার জন্য। এই কট্টর নাস্তিক নাট্যকার রিশেলুর মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পর জন্মেছিলেন, তিনি কার্ডিনালের সিক্রেটটার ধারক, এটা আমার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু আমাকে সেটা খুঁজে বের করতে হবে। কয়েক সপ্তাহ পর আমি ভলতেয়ারের সাথে দেখা করার সুযোগ পাই।
যাজকের পোশাকে আমি যথা সময়ে হাজির হই তার বাড়িতে। আমাকে তার শয়নকক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো সরাসরি। দুপুরের আগে ঘুম থেকে উঠতে তিনি পছন্দ করতেন না। মাঝেমাঝে সারাটা দিনই বিছানায় কাটিয়ে দিতেন। চল্লিশ বছর ধরেই আশংকা করা হচ্ছিলো তিনি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন।
সাদা ধবধবে একটি গাউন পরে বেশ কয়েকটি বালিশে মাথা রেখে আধো শায়িত আধো বসা অবস্থায় ছিলেন তিনি। ফ্যাকাশে মুখে তার ঘন কালো চোখ দুটো সবার আগে চোখে পড়ে। খাড়া নাক দেখে শিকারী কোনো পাখির মতোই মনে হয়।
বেশ কয়েকজন যাজক তার ঘরে ছিলো। তাদেরকে চলে যাবার জন্যে অনুরোধ করছিলেন বার বার। কোনো রকম প্রার্থনা কিংবা ক্ষমা চাইতে রাজি ছিলেন না। যাজকের পোশাকে আমাকে দেখে যখন মুখ তুলে তাকালেন আমি যারপরনাই বিব্রত বোধ করলাম। ভালো করেই জানতাম তিনি যাজকদের মনেপ্রাণে ঘৃণা করেন। রোগাটে হাত নেড়ে যাজকদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন:
“দয়া করে এবার আমাদের একটু একা থাকতে দিন! এই তরুণের জন্যে আমি অপেক্ষা করছিলাম এতোক্ষণ। সে কার্ডিনাল রিশের দূত হিসেবে এসেছে আমার কাছে!”
যাজকের দল পেছন ফিরে আমার দিকে তাকালে তিনি অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়লেন। তড়িঘড়ি করে তারা ঘর থেকে চলে গেলো, যেনো ভয় পেয়ে গেছে। ভলতেয়ার আমাকে তার কাছে এসে বসতে বললেন।
“এটা আমার কাছে সব সময়ই রহস্যের উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছিলো,” রেগেমেগে বললেন তিনি। “ঐ বাগাড়ম্বরপ্রিয় ভুতটা কেন তার কবরে চুপচাপ থাকতে পারে না বুঝি না! এক মৃত যাজকের ভুত কবর থেকে উঠে তরুণদের উপদেশ দেয় আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য, ব্যাপারটা একজন নাস্তিক হিসেবে আমার জন্য খুবই বিব্রতকর। ঐ ভুতটার কাছ থেকে যখনই তারা আসে আমি তাদেরকে দেখামাত্রই বলে দিতে পারি সেটা। তাদের চোখে-মুখে এক ধরণের ভাবালুতা থাকে, ঠিক এখন তোমার যেমন হচ্ছে…ফার্নিতে যখন ছিলাম সেখানেও এমনটি হতো, কিন্তু প্যারিসে আসার পর থেকে সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে!
তার কথা শুনে বিরক্তি লুকিয়ে রাখলাম। একই সাথে অবাক আর সতর্ক হয়ে উঠলাম আমি-কারণ ভলতেয়ার এখানে আমার আগমনের উদ্দেশ্যটা আগে থেকেই জেনে গেছেন বলে। তিনি আরো বললেন, অন্য অনেকেই নাকি একই উদ্দেশ্যে তার কাছে আসে।
“ইস্…ঐ লোকটার বুকে যদি একটা বিশাল চাকু বসিয়ে দিতে পারতাম, ক্ষিপ্তকণ্ঠে বলতে লাগলেন তিনি। “তাহলে হয়তো একটু শান্তি পেতাম।” কথাটা বলেই কাশতে লাগলেন। দেখতে পেলাম তার মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। কিন্তু তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে গেলে তিনি হাত নেড়ে আমায় বারণ করে। দিলেন।
“ডাক্তার আর যাজকদের একই দড়িতে ফাঁসি হওয়া উচিত!” চিৎকার করে বলেই পানির গ্লাসটা নেবার জন্যে হাত বাড়ালেন। আমি সেটা তুলে তার হাতে দিলে তিনি কয়েক চুমুক পানি পান করলেন।
“সে ঐ পাণ্ডুলিপিটা চায়, জানি। কার্ডিনাল রিশেলু এটা মেনে নিতে পারছে না তার মহামূল্যবান ব্যক্তিগত জানালটা আমার মতো নাস্তিকের কাছে আছে।”
“আপনার কাছে কার্ডিনাল রিশেলুর ব্যক্তিগত জানালটা আছে?”
“হ্যাঁ, আছে। অনেক বছর আগে, আমি যখন তরুণ ছিলাম তখন আমাদের রাজার রোমান্টিক জীবন নিয়ে একটা কবিতা লিখে রাজদ্রোহের অভিযোগে জেলে গেছিলাম। জেলে বসে যখন পচছিলাম তখন এক ধনী পৃষ্ঠপোষক আমার কাছে কিছু জানাল নিয়ে আসে সেগুলোর অর্থ উদ্ধার করার জন্য। ওগুলো তাদের পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে বহুকাল থেকেই সংরক্ষিত ছিলো। কিন্তু একটা সিক্রেট কোডে লিখিত ছিলো বলে সেটা কেউ পড়তে পারে নি। আমার যেহেত করার মতো কিছু ছিলো না তাই সেগুলোর অথোদ্ধার করি এবং আমাদের প্রাণপ্রিয় কার্ডিনাল সম্পর্কে প্রচুর তথ্য জানতে পারি।”
“আমি তো জানতাম রিশেলু তার সমস্ত জানাল সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে দান। করে গেছেন?”
“তোমরা এমনটাই জানো, বাঁকা হাসি হাসলেন ভলতেয়ার। “একজন যাজক তার ব্যক্তিগত জানাল সাংকেতিক ভাষায় লিখে যাবে না, যদি না লুকিয়ে রাখার মতো কিছু থাকে। ঐ সময় যাজকেরা কী রকম আকাম-কুকাম করতে তার সবই আমি জানতাম : হস্তমৈথুন, লালসা। আমি জার্নালের উপর হুমরি খেয়ে পড়লাম কিন্তু যা আশা করেছিলাম তার কিছুই পেলাম না। পেলাম একেবারে অন্য কিছু। পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখা। অর্থহীন আর আজগুবি জিনিসই সেটাকে বলা যেতে পারে। এরকম অর্থহীন জিনিস জীবনেও আমি দেখি নি।”
ভলতেয়ার এমনভাবে কাশতে লাগলেন যে আমার কাছে মনে হলো পাশের ঘরে গিয়ে যাজকদের ডেকে আনি, যেহেতু তখনও আমার ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান। পালন করার অনুমতি ছিলো না। কিন্তু তিনি মৃত্যুবৎ কাশি দিতে দিতে আমাকে একটা চাদর এনে তার গায়ে জড়িয়ে দিতে বললেন। আমি তাই করলাম। মাথাটাও চাদরে মুড়িয়ে নিলেন তিনি। লক্ষ্য করলাম তার সারা শরীর কাঁপছে।