দ্রলোকের কথা চুপচাপ শুনে গেলাম আমি। মনে মনে ভাবতে লাগলাম সূর্য পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে আসলে তার দু’চোখই নষ্ট হয়ে গেছে।
“পুরুষদের একটা সিক্রেট সোসাইটি আছে, তারা মনে করে সভ্যতার পরিক্রমা বদলে দেয়াই তাদের কাজ,” ইউলার আমাকে বললেন। আমরা বসেছিলাম তার ল্যাবরেটরির মাঝখানে, আমাদের চারপাশে ছিলো অসংখ্য টেলিস্কোপ, মাইক্রোস্কোপ, মোটা মোটা বই-পুস্তক আর স্তূপ করে রাখা কাগজপত্র। এইসব লোকেরা নিজেদেরকে বিজ্ঞানী আর প্রকৌশলী হিসেবে দাবি করলেও বাস্তবে তারা হলো আধ্যাত্মবাদী। তাদের ইতিহাস সম্পর্কে আমি যা জানি সেটা আপনাকে বলছি, এটা হয়তো আপনার জন্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
“১২৭১ সালে ইংল্যান্ডের যুবরাজ, তৃতীয় হেনরির ছেলে এডওয়ার্ড ক্রুসেড লড়ার জন্য উত্তর-আফ্রিকার উপকূলে যান। জেরুজালেম শহরের কাছে একর নামের একটি জায়গায় অবতরণ করেন তিনি। সেখানে তিনি কী করেছেন না। করেছেন সে ব্যাপারে আমরা খুব একটা জানি না। শুধু জানি বেশ কয়েকটি লড়াই করেছিলেন, ওখানকার সম্প্রদায়ের শাসক মুসলিম মুরদের সাথেও দেখা হয়েছিলো তার। পরের বছরই তার বাবার মৃত্যুর কারণে তাকে দেশে ফিরে আসতে হয়। ফিরে এসেই তিনি হয়ে যান ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ড। বাকিটা ইতিহাসের বইতেই পাবেন। কিন্তু যেটা পাবেন না সেটা হলো আফ্রিকা থেকে তিনি কি নিয়ে এসেছিলেন।”
“সেটা কি?” আমি জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলাম।
“এক মহান সিক্রেট জ্ঞান নিয়ে এসেছিলেন তিনি। এমন একটা সিক্রেট যা সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই ছিলো,” ইউলার জবাবে বললেন। “তবে আমার গল্পটা তার পরের ঘটনা।
“ফিরে আসার পর কিং এডওয়ার্ড ইংল্যান্ডে একটি সোসাইটি গঠন করে সেখানে তিনি তার সিক্রেটটা শেয়ার করেন। তাদের ব্যাপারে আমরা খুব কমই জানি, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের গতিবিধি অনুসরণ করতে পারি আমরা। স্কটল্যান্ড অধিগ্রহণ করার পর আমরা জানতে পারি এই সোসাইটি সেখানেও বিস্তার লাভ করেছিলো। বেশ দীর্ঘদিন সেখানে চুপচাপ ছিলো তারা। এই শতকে জ্যাকোবাইটরা যখন স্কটল্যান্ড থেকে পালিয়ে ফ্রান্সে চলে আসে তখন তারা সোসাইটিটিও সাথে করে নিয়ে এসেছিলো। ফ্রান্সে এসে তারা এর শিক্ষা দিতে। শুরু করে। ইংল্যান্ডে সোজানের সময়কালে ফ্রান্সের বিখ্যাত কবি মতেস্কু এই মতবাদে দীক্ষিত হন। তার সহায়তায়ই ১৭৩৪ সালে প্যারিসে স্থাপিত হয় লগি দে সায়েন্সে। তার চার বছর পর, আমাদের প্রুশিয়ার রাজা ফ্রেডারিক সিংহাসনে। অধিষ্ঠিত হবার আগে, ব্রুন্সউইকে অবস্থিত এই সোসাইটিতে দীক্ষিত হন। একই বছর, পোপ দ্বাদশ ক্লেমেন্ট এই সোসাইটির কার্যক্রমের বিরুদ্ধে একটা বিল ইসু করেন। এটা এখন ইতালি, প্রুশিয়া, অস্ট্রিয়া এবং ফ্রান্সের মতো নীচুভূমিতেও ছড়িয়ে পড়েছে। তখন ঐ সোসাইটি এতোটাই শক্তিশালী ছিলো যে ক্যাথলিক ফ্রান্সের পালামেন্ট পোপের এই আদেশ রেজিস্টার করতে অস্বীকৃতি জানায়।”
“আপনি আমাকে এসব কেন বলছেন?” ডক্টর ইউলারকে জিজ্ঞেস করলাম। এইসব লোকের লক্ষ্য সম্পর্কে যদি আমি অবগতও হই তাতে আমার কি এসে যায়? এ ব্যাপারে আমি কীইবা করতে পারবো? যদিও আমার অনেক কিছু করার আকাঙ্খা আছে, কিন্তু আমি তো এখন নিতান্তই একজন বালিকা।”
“তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে আমি যতোটুকু জানি,” আস্তে করে বললেন ইউলার, “তাতে নিশ্চিত বুঝতে পারছি, এই লোকগুলোকে যদি পরাস্ত না করা যায় তাহলে তারাই সমগ্র দুনিয়াকে পরাস্ত করে ফেলবে। আজ হয়তো আপনি অল্পবয়সী এক বালিকা মাত্র, কিন্তু খুব শীঘ্রই রাশিয়ার জারপত্নি হবেন, বিগত দু’দশকের মধ্যে ঐ সাম্রাজ্যের প্রথম পুরুষ শাসকের স্ত্রী। আমি যা বলবো সেটা আপনার শোনা উচিত, তারপর ব্যাপারটা নিয়ে ভাববেন নাকি ভাববেন না সেটা আপনার অভিরুচি।” আমার হাতটা ধরলেন তিনি।
“কখনও কখনও এইসব লোক নিজেদেরকে ম্যাসন ভ্রাতৃসংঘ কিংবা রসিকুশিয়ান বলে অভিহিত করে। তারা নিজেদের জন্য যে নামই বেছে নিক না কেন, তাদের মধ্যে একটা জিনিস কমন। তাদের উৎপত্তি উত্তর-আফ্রিকায়। যুবরাজ এডওয়ার্ড যখন পশ্চিমের মাটিতে এই সোসাইটি স্থাপন করেন তখন এটার নাম দেন দ্য অর্ডার অব দি আর্কিটেক্টস অব আফ্রিকা। তারা মনে করে তাদের পূর্ব-পুরুষেরা ছিলো প্রাচীন মিশরের পিরামিড আর পাথর খোদাই করে নির্মাণ কাজের স্থপতি। তারাই ব্যাবিলনের শূণ্য উদ্যান, বাবেল গেট আর টাওয়ার বানিয়েছে। তারা প্রাচীনকালের রহস্যগুলো জানে। তবে আমি বিশ্বাস করি তারা অন্য একটা জিনিসের স্থপতি, এটা অনেক বেশি সাম্প্রতিক আর আগের যেকোনো কিছুর তুলনায় অনেক বেশি ক্ষমতাশালী…”
ইউলার একটু থেমে আমার দিকে যেভাবে তাকিয়েছিলেন সেটা আমি জীবনেও ভুলতে পারবো না। আজো সেই চাহনি আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। যেনো পঞ্চাশ বছর আগে নয়, এটা ঘটেছে কিছুক্ষণ আগে। এচণ্ড ভীতির সাথে আমি তাকে স্বপ্নে দেখি, আমার কানে ফিসফিস করে বলা কথাগুলো, তার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস এখনও টের পাই, মনে হয় তিনি আমার পেছনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছেন :
“আমার বিশ্বাস তারা মন্তগ্লেইন সার্ভিসেরও স্থপতি। নিজেদেরকে তারা এর যথার্থ উত্তরাধিকার হিসেবেই বিবেচনা করে।”