“সত্যিকারের নয় নিশ্চয়?” ভ্যালেন্টাইন বললো। চাদরের নীচে মিরিয়ের হাতটা ধরে ফেললো সে। মেয়ে দুটোকে দেখে খুব রোমাঞ্চিত বলে মনে হলো তার।
“শুনতে হয়তো একদম অবাস্তব মনে হবে,” বলেই হেসে ফেললো সে। “তবে বলতে পারি একটা শর্তে। তোমরা কখনও তোমাদের আঙ্কেল জ্যাক সুইকে এটা বলতে পারবে না। যদি বলো তাহলে আমি অ্যাসেম্বলিতে হাসিরপাত্র হয়ে যাবো।”
চাদরের নীচে মেয়ে দুটো খিল খিল করে হেসে ফেললো, তারা প্রতীজ্ঞা করলো কাউকেই এ কথা বলবে না। মৃদু মোমবাতির আলোয় গল্পটা বলতে শুরু করলো তয়িরাঁ মরিস…
বিশপের গল্প
যাজক হবার আগে, আমার বয়স তখন খুব কম ছিলো, সেন্ট রেমি ছেড়ে চলে গেছিলাম সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে, ওখানে বিখ্যাত রাজা কোলভিস শায়িত আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’বছর থাকার পর আমার ডাক এলো।
জানতাম আমি যদি তাদের কথামতো যাজক না হই তাহলে বিরাট একটা কেলেংকারী হয়ে যাবে। তারপরও যাজক হবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার ছিলো না। সঙ্গোপনে আমি একজন রাষ্ট্রনায়ক হবার ইচ্ছে পোষণ করতাম সব সময়।
সরবোনের ভেতরে যে চ্যাপেল আছে তাতে শুয়ে আছেন আমার আর্দশ, ফ্রান্সের সেরা সন্তানদের একজন, তার নাম তোমরা অবশ্যই জানো : আরমান্দ জঁ দু পেসিস দয়ে দ্য রিশেলু। ধর্ম আর রাজনীতির এক বিরল মিশ্রণ ছিলো তার মধ্যে। ১৬৪২ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত বিশ বছর ধরে তিনি আমাদের দেশটাকে শক্ত হাতে শাসন করেছিলেন।
এক মাঝরাতে আমি আমার ডরমিটরি ছেড়ে মাথায় ক্যাপ পরে রওনা হলাম সরবোনের চ্যাপেলের উদ্দেশ্যে।
প্রবল বাতাস বইছিলো। লনের উপর উড়ছিলো গাছের মরা পাতা। রাতের নিশুধিতে পেঁচা আর নিশাচর প্রাণীদের অদ্ভুত ডাক শোনা যাচ্ছিলো চারপাশে। আমি নিজেকে অনেক সাহসী ভাবলেও এটা স্বীকার করতে কোনো লজ্জা নেই যে খুব ভয় পেয়েছিলাম। চ্যাপেলের ভেতরে কবরটা দেখতে অন্ধকারাচ্ছন্ন আর শীতল বলে মনে হচ্ছিলো। রাতের ঐ সময়টাতে প্রার্থনা করার জন্য কেউ ছিলো না সেখানে। থাকার কথাও নয়। কবরের পাশে একটা মোমবাতি নিভু নিভু করে জ্বলছিলো। আমি আরেকটা মোমবাতি জ্বালিয়ে হাটু গেড়ে বসে পড়ি প্রার্থনা করার জন্য যাতে করে ফ্রান্সের এই সাবেক যাজক আমাকে পথ বাতলে দেন। ঐ কক্ষে নিজের হৃদস্পন্দন পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি আমার আবেদন জানাতে শুরু করলাম শান্তকণ্ঠে।
আমার কণ্ঠ ছাপিয়ে আচমকা বাতাসের শব্দ হতে লাগলো। প্রচণ্ড হিমশীতল বাতাস নিভিয়ে দিলো মোমবাতি দুটো। ভয়ে আমার হাত-পা বরফের মতো জমে গেলো। অন্ধকারে হাতরাতে হাতরাতে আরেকটা মোমবাতি জ্বালানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু তখনই একটা কণ্ঠ শুনতে পেলাম আমি। কবর থেকে উঠে আসতে দেখলাম সাদা, জ্বলজ্বলে কার্ডিনাল রিশেলুর ভূতটাকে! তার চুল, গায়ের রঙ, এমনকি আলখেল্লাটা পর্যন্ত ধবধবে সাদা আর স্বচ্ছ। আমার উপরে ভাসতে লাগলেন তিনি।
আমি যদি হাটু গেড়ে বসে না থাকতাম তাহলে ঐ দৃশ্যটা দেখেই মাটিতে পড়ে যেতাম। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললাম। এরপর আবারো একটা ফিসফিসানি শুনতে পেলাম কাছ থেকে। কার্ডিনালের ভুতটা আমার সাথে কথা বলছে! আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল একটি প্রবাহ বয়ে গেলো। কার্ডিনালের কণ্ঠটা বেশ ভরাট আর গম্ভীর।
“আমাকে জাগালি কেন?” বিস্ফোরিত হলো তার কণ্ঠ। অন্ধকারে আমার চারপাশে দমকা বাতাস বইতে লাগলো এ সময়। কিন্তু আমার পা দুটো এতোটাই দূর্বল ছিলো যে পালানোর শক্তিও ছিলো না। ঢোক গিলে কম্পিত কণ্ঠে জবাব দিলাম আমি।
“কার্ডিনাল রিশেলু। আমি উপদেশ চাইছি আপনার কাছে। জীবিত অবস্থায় আপনি ছিলেন ফ্রান্সের সেরা রাষ্ট্রনায়ক, যদিও আপনি একজন যাজক ছিলেন। এরকম ক্ষমতা আপনি কিভাবে আয়ত্তে আনতে পারলেন? দয়া করে আপনার সিক্রেটটা আমার সাথে শেয়ার করুন, কারণ আমি আপনার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চাই।”
“তুই?” ভুতটা যেনো অন্ধকারে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে এরকম শব্দ শোনা যেতে লাগলো। আমি নিজের ভেতরে কুকড়ে গেলাম। অবশেষে ভুতটা কথা বললো।
“যে সিক্রেটটা আমি হন্যে হয়ে খুঁজেছি সেটা চিরতরের জন্যে রহস্য হয়ে আছে…” সাদা-স্বচ্ছ ভুতটা ঘরের ছাদের উপর ভাসছে। এর ক্ষমতা শায়িত আছে শার্লেমেইনের সাথে। আমি শুধু প্রথম চাবিটা খুঁজে পেয়েছিলাম। আমি সেটা খুব সাবধানে লুকিয়ে রেখেছি…”
উনি, মানে উনার ভূতটা দেয়ালের মাঝে যেনো মিশে গেলেন আস্তে আস্তে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে উদভ্রান্তের মতো তাকে ধরে রাখতে চাচ্ছিলাম, চাচ্ছিলাম উনি যেনো চলে না যান। আমাকে কিসের ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন? শার্লেমেইনের সাথে কোন্ সিক্রেটটা লুকিয়ে আছে? আমি চিৎকার করে ভুতটার কাছে এই প্রশ্ন করলাম কিন্তু ততক্ষণে উনি উধাও গেছেন।
“হে মহান যাজক! আপনি কোন্ চাবি খুঁজে বের করার কথা বললেন আমাকে?”
সঙ্গত কারণেই কোনো জবাব এলো না। কিন্তু তার কণ্ঠস্বর তখনও আমার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো।
“ফ্রাসোঁয়া…ম্যারি…আরুয়েঁ…” শুধু এইটুকুই।
থিতু হয়ে এলো দমকা বাতাস। মোমবাতির আলো আবার জ্বলে উঠলো। আমি একা দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে। দীর্ঘক্ষণ পর ওখান থেকে ফিরে এলাম ডরমিটরিতে।
পর দিন সকালে আমার বিশ্বাস করা উচিত ছিলো পুরো ঘটনাটি নিছক কোনো স্বপ্ন। কিন্তু মরা পাতা আর কবরের কাছে যে হালকা ঘ্রাণ সেটা আমাকে বুঝিয়ে দিলো পুরো ব্যাপরটাই সত্যি ছিলো। কার্ডিনাল আমাকে বলেছেন তিনি। রহস্যের প্রথম চাবিটা পেয়েছিলেন। সঙ্গত কারণেই আমি এই চাবিটা খুঁজতে শুরু করলাম ফ্রান্সের বিখ্যাত কবি, নাট্যকার ফ্রাসোয় মারি আরুয়েঁ, যিনি ভলতেয়ার নামেই বেশি পরিচিত, তার মাধ্যমে।