“বেচারা পা’টা,” বললো ভ্যালেন্টাইন। “অনেক যন্ত্রণা সহ্য করেছিস তুই অথচ এতোটা তোর প্রাপ্য ছিলো না।”
তয়িরাঁ ঝুঁকে ভ্যালেন্টাইনের থুতনীটা ধরে আলতো করে তার ঠোঁটে চুমু খেলো।
“তুমি ছাড়া আর কেউ আমার পা’কে এভাবে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করে নি, হেসে বললো সে। “তুমি আমার পা’টাকে অনেক অনেক সুখি করেছে।”
দেবদূতের মতো সুন্দর আর নিষ্পাপ মুখে ভ্যালেন্টাইনের দিকে তাকালো সে। তার সোনালি চুলগুলো ফায়ারপ্লেসের আগুনের আলোয় আভা ছড়াচ্ছে। মিরিয়ের ভাবতে খুব কষ্ট হলো, এই লোকটাই একক প্রচেষ্টায় নির্দয়ভাবে ফ্রান্সের ক্যাথলিক চার্চকে ধ্বংস করছে। এই একই লোক মন্তগেইন সার্ভিসটাও হস্তগত করতে উদগ্রীব।
.
মরিসের স্টাডিতে মোমবাতিগুলো শেষ হয়ে আসছে। ফায়ারপ্লেসের নিভু নিভু আলোয় পুরো ঘরে অন্ধকার নেমে এলো। বিশাল দেয়ালঘড়িটায় তাকিয়ে মরিস বুঝতে পারলো রাত দুটোরও বেশি বেজে গেছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। চেয়ারের নীচে মেঝের কার্পেটের উপর বসে আছে মিরিয়ে আর ভ্যালেন্টাইন।
“আমি তোমাদের আঙ্কেলকে বলেছিলাম বেশি রাত হওয়ার আগেই তোমাদেরকে বাসায় পৌঁছে দেবো,” মেয়ে দুটোকে বললো সে। “এখন দ্যাখো, কটা বাজে।”
“ওহ্ আঙ্কেল মরিস,” অনুনয় করে বললো ভ্যালেন্টাইন। “আমাদেরকে এখনই যেতে বলবেন না, প্লিজ। এই প্রথম কোনো সামাজিক পরিবেশে থাকার সুযোগ আমরা পেয়েছি। প্যারিসে আসার পর থেকে আমাদের মনে হচ্ছিলো আমরা বুঝি কনভেন্টেই রয়েছি।”
“আরেকটা গল্প বলেন, মিরিয়েও আরো কিছুক্ষণ থেকে যাবার পক্ষে। “আমাদের আঙ্কেল কিছু মনে করবেন না।”
“উনি খুব রাগ করবেন,” হেসে বললো তয়িরাঁ। “তবে এরইমধ্যে এতো রাত হয়ে গেছে তোমাদেরকে বাড়ি পৌঁছানো যাবে না। রাতের এই সময় ভদ্রলোকদের এলাকায়ও মাতাল আর জোচ্চোরের দল ঘুরে বেড়ায়। আমার মনে হয় একজন লোক মারফত তোমাদের আঙ্কেলের কাছে চিঠি পাঠিয়ে দিলেই ভালো হয়। আমি আমার গহপরিচারিকাকে বলছি তোমাদের জন্য একটা ঘর ঠিক করে দিতে। আমার মনে হয় তোমরা একসাথে থাকতেই পছন্দ করবে, তাই না?”
মেয়ে দুটোকে এ সময় বাড়িতে পৌঁছানোটা বিপজ্জনক হবে, কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। তয়িরাঁর বাড়িতে অসংখ্য চাকর-বাকর আছে, আর ডেভিডের বাড়িটাও খুব বেশি দূরের নয়। কিন্তু আচমকাই তার মনে হচ্ছে মেয়ে দুটোকে এ মুহূর্তে বাড়ি পৌঁছে দিতে চাচ্ছে না সে। হয়তো চিরদিনের জন্যেই রেখে দেয়ার বাসনাও জেগেছে মনে। গল্প বলারছলে সে দেরি করে ফেলেছে। এই অল্পবয়সী দুটো মেয়ে, তাদের নিষ্কলুষতা আর তারুণ্য দিয়ে মরিসের মনের গভীরে এমন এক অনুভূতির জন্ম দিয়েছে যে সে নিজেও সেটা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছে না। তার জীবনে পরিবার বলতে তেমন কিছু ছিলো না। এই মেয়ে দুটোর উপস্থিতিতে যে উষ্ণতার ছোঁয়া সে পাচ্ছে সেটা তার জন্য একেবারে নতুন একটি অভিজ্ঞতা।
“ওহ সত্যি! আমরা তাহলে আজ রাতটা এখানেই থাকছি?” ভ্যালেন্টাইন উঠে দাঁড়ালো, মিরিয়ের হাত ধরে মোচড়াতে শুরু করলো সে। মিরিয়ে নিজেও থাকার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ছিলো তবে সেটা প্রকাশ করলো না।
“অবশ্যই,” কথাটা বলেই মরিস চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো বেল বাজানোর জন্য। তবে এই কামনা করো কাল সকালে যেনো প্যারিসে আবার বদনাম রটে যায়, জারমেঁই যেমনটা বলেছিলো।”
দ্রগোছের দেখতে গৃহপরিচারিকা লোকটি স্টাডিতে ঢুকেই এলোমেলো চুলের দুই তরুণীর দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো, তারপর নজর গেলো তার মনিবের দিকে। এক পায়ের জুতা নেই। খালি পা। কিছু না বলে চুপচাপ মেয়ে দুটোকে নিয়ে উপরতলায় গেস্টরুমে চলে গেলো সে।
“মঁসিয়ে, শোয়ার জন্যে পরতে পারি এরকম দুটো পোশাক কি জোগার করে দিতে পারবেন?” বললো মিরিয়ে। “আপনাদের মহিলা গৃহপরিচারিকাদের পোশাক হলেও চলবে…”।
“কোনো সমস্যা নেই, ব্যবস্থা করা যাবে,” গৃহপরিচারিকা দ্রভাবে বলেই দুটো সিল্কের গাউন এনে দিলো তাদের জন্য। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এগুলো কোনো চাকরানীর পোশাক নয়। খুবই সুন্দর আর অভিজাত। গৃহপরিচারিকা চুপচাপ ঘর থেকে চলে গেলো তাদের রেখে।
ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে জামা পাল্টে চুল আঁচড়িয়ে নরম আর রাজকীয় বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই মরিস দরজায় টোকা মারলো।
“সব ঠিক আছে তো?” দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো সে।
“এটা আমার জীবনে দেখা সবচাইতে চমৎকার বিছানা,” জবাব দিলো মিরিয়ে। “কনভেন্টে আমরা কাঠের শক্ত খাটের উপর শুতাম নিজেদের শরীর ঠিক রাখার জন্য।”
“দারুণ আরাম পাবে, ভালো ঘুমও আসবে, দেখো,” হেসে বললো মরিস। বিছানার পাশে ছোট্ট সোফায় বসে পড়লো সে।
“এখন আরেকটা গল্প বলেন,” বললো ভ্যালেন্টাইন।
“অনেক রাত হয়ে গেছে তো…”
“একটা ভুতের গল্প বলেন তাহলে!” ভ্যালেন্টাইন আগ্রহভরে বললো। “অ্যাবি আমাদেরকে কখনই ভুতের গল্প শোনার অনুমতি দিতেন না, তারপরও আমরা শুনতাম। আপনি কি কোনো ভুতের গল্প জানেন?”
“দুঃখের বিষয়, একটাও জানি না, বিষণ্ণ হয়ে বললো মরিস। “তোমরা তো জানোই আমার স্বাভাবিক কোনো শৈশব ছিলো না। এরকম কোনো গল্প আমাকে কেউ শোনায় নি।” একটু ভেবে সে আবার বললো, “তবে সত্যি বলতে কি, একবার ভুতের সাথে আমার দেখা হয়ে গিয়েছিলো।”