“তোমরা দুজনেই অসম্ভব সুন্দরী, মরিস হেসে বললো। “তবে তার উপর বাড়তি কি করলে আরো ভালো হবে সেটা আমরা দেখবো। তোমাদের ভাগ্য ভালো, আমার এক বন্ধু আছে যার অধীনে রয়েছে প্যারিসের সবচাইতে সেরা পোশাক নির্মাতারা-হয়তো তোমরা মাদাম দ্য স্তায়েলের নাম শুনেছো?”
.
প্যারিসের সবাই জারমেঁই দ্য স্তায়েলের নাম শুনেছে, ফলে ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়েও খুব জলদিই এই নামটার সাথে পরিচিত হয়ে গেলো। অপেরা-কমিকের গোল্ড অ্যান্ড বু-বক্সে তার সাথে বসলো তারা। অপেরা হাউজের বেলকনির বক্সগুলো পূর্ণ করে রেখেছে প্যারিসের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। এদের মধ্যে। সবচাইতে জাঁকজমক পোশাক আর জুয়েলারি পরে আছে যারা তাদেরকে জুইসে। দোরি বলে ডাকা হয়। ভেতরে যে হীরা-জহরত, মণি-মুক্তা আর লেসের সমারোহ দেখা যাচ্ছে সেটা এখন বাইরে রাস্তায় সচরাচর দেখা যায় না, কয়ে এখনও বিপ্লবের বেশ চলছে। রাজপরিবার চরম দুর্দশার মধ্যে বন্দী হয় তা নিজেদের প্রাসাদে। প্রতি সকালে ঘোড়ার গাড়িতে করে আর্তনাদরত যাজক আয় অভিজাত পরিবারের লোকদেরকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয় প্রেস দ্য রেভুলুশনের পাথর বিছানো রাস্তা দিয়ে। অপেরা-কর্মিকের ভেতরে অবশ জাঁকজমক আর উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। তারমধ্যে সবচাই জাঁকজমক হলো জারমেঁই দ্য স্তায়েল।
এই মহিলা সম্পর্কে ভ্যালেন্টাইন যা কিছু জানতে পেরেছে তার সবটাই তার আঙ্কেল জ্যাক-লুইয়ের কাজের লোকদেরকে নানা ধরণের প্রশ্ন করার মাধ্যমে। তারা তাকে বলেছে মাদাম স্তয়েল হলো সুইজারল্যান্ডের অসাধারণ মেধাবী অর্থমন্ত্রী জ্যাক নেকারের মেয়ে। যোড়শ লুই তাকে দু দু’বার নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন, আবার ফরাসি জনগণের দাবির মুখে দুবারই তাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিলো আগের পদে। তার মা সুজান নেকার প্যারিসে সবচাইতে শক্তিশালী। সেলুন পরিচালনা করেছেন বিশ বছর ধরে, সেখানে জারমেঁই ছিলো সবচাইতে বড় আকর্ষণ।
নিজের যোগ্যতায় মিলিয়নেয়ার হয়েছে মহিলা, টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে মাত্র বিশ বছর বয়সী ফ্রান্সে নিযুক্ত অকর্মা সুইডিশ রাষ্ট্রদূত ব্যারোন এরিক স্তায়েল ফন হোলস্টেইন নামের এক স্বামীকে। মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সে সুইডিশ অ্যাম্বাসিতে একটি সেলুন খুলেছিলো। আর সেখান থেকেই রাজনীতির ময়দানে ঢুকে পড়ে ভদ্রমহিলা। তার বাড়িতে সব সময়ই ভীড় করে থাকে ফ্রান্সের রাজনীতি আর সাংস্কৃতিক জগতের হোমরাচোমরারা : লাফায়েত, কোঁদোরসে, নারবোনে, তয়িরাঁ। জারমেঁই হয়ে উঠেছে একজন দার্শনিক বিপ্লবী। সব ধরণের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তার সেলুনের চৌহদ্দির মধ্যেই নেয়া হয়ে থাকে। এমন সব লেকজন তার বাড়িতে আসে যাদেরকে একসাথে জড়ো করা কেবল তার পক্ষেই সম্ভব। বর্তমানে পঁচিশ বছর বয়সী এই মহিলা সম্ভবত ফ্রান্সের সবচাইতে ক্ষমতাশালী নারী।
মরিস তয়িরাঁ অপেরা হাউজের বক্সে এসে তিনজন মহিলার সাথে বসতেই ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে ভালো করে দেখতে লাগলো মাদাম দ্য স্তায়েলকে। কালো-সোনালি লেসের লো-কাট গাউন তার ভারি হাত দুটো আর পেশীবহুল চওড়া কাঁধকে প্রকট করে তুলেছে, ভারি কোমরের কারণে তার দৈহিক অবয়বটা আরো বেশি দর্শণগ্রাহ্য মনে হয়। গলায় পরে আছে রুবি আর দামি রত্ম বসানো স্বর্ণের নেকলেস। মাথায় সোনালি রঙের যে পাগড়ির মতো টুপি পরে আছে সেটা তার ট্রেডমার্ক। ভ্যালেন্টাইনের পাশেই বসে আছে সে, একটু ঝুঁকে তার সাথে নীচু স্বরে কথা বলছে। নীচুস্বর হলেও সেই কণ্ঠ এতোটাই গমগম করছে যে আশেপাশের সবার সেটা নিতে পাওয়ার কথা।
“মাই ডিয়ার, আগামীকাল সকালের মধ্যে প্যারিসের সবাই আমার দরজার সামনে হুমরি খেয়ে পড়বে, অবাক হয়ে তারা ভাববে কারা এই দুই তরুণী। এটা হবে একটি উপভোগ্য কেলেংকারি, আমি নিশ্চিত তোমাদেরকে যিনি নিয়ে এসেছেন তিনি এটা ভালো করেই বুঝতে পেরেছেন, তা না হলে আরো ভালো পোশাকে তোমাদেরকে এখানে নিয়ে আসতেন।”
“মাদাম, আমাদের পোশাক কি আপনার কাছে ভালো লাগে নি?” উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো ভ্যালেন্টাইন।
“তোমরা দু’জনেই দারুণ সুন্দরী, মাই ডিয়ার,” বললো জারমেঁই। “কিন্তু সাদা হলো কুমারিদের রঙ, টকটকে গোলাপি নয়। আর যদিও তরুণীদের বক্ষা হলো বর্তমান সময়ে প্যারিসে আকর্ষণীয় একটি জিনিস, তারপরও বিশের নীচে যাদের বয়স তারা হালকা একটা ওড়না ব্যবহার করে শরীর ঢাকার জন্য। এটা মঁসিয়ে তয়িরাঁ ভালো করেই জানেন।”
ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে লজ্জায় আরক্তিম হয়ে গেলো। তবে কথার মাঝখানে ঢুকে পড়লো মরিস তয়িরাঁ, “আমি আমার নিজস্ব ফ্যাশনে ফ্রান্সকে মুক্ত করেছি।” জারমেঁই এবং সে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললে মহিলা কাঁধ তুললো।
“আশা করি তোমরা এই অপেরা দারুণ উপভোগ করেছো, মিরিয়ের দিকে তাকিয়ে বললো জারমেঁই। “এটা আমার অনেক প্রিয় অপেরার একটি। সেই ছেলেবেলা থেকে এটা আর দেখি নি। এর সঙ্গিতকার আদ্রে ফিলিদোর ইউরোপের সেরা দাবা খেলোয়াড়। দার্শনিক আর রাজ-রাজাদের সামনে তিনি সঙ্গিত পরিবেশন করেন, দাবা খেলে থাকেন। তোমাদের কাছে হয়তো সঙ্গিতটা একটু পুরনো ধাঁচের মনে হতে পারে, এর কারণ অপেরায় বিপ্লব এনে দিয়েছেন। গ্লাক। খুব বেশি আবৃত্তি শোনাটা একটু কষ্টকরই হয়ে যায়…”