তারা যে মন্তগ্লেইন থেকে এসেছে এটা জানাই মারাত্মক বিপজ্জনক হয়ে গেছে। আর যদি জানতে পারে তারা এখানে আসার দিন রাতেই স্টুডিওর বাইরে বাগানের মাটির নীচে দাবার খুঁটি দুটো লুকিয়ে রেখেছে তাহলে বিপদ আরো বেড়ে যাবে। অ্যাবিস যে তাদের দু’জনকে গুরুদায়িত্ব দিয়ে শপথ করিয়েছে সেটা তার ভালোই মনে আছে। অন্য নানদের সাথে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে তাদেরকে। যদি কেউ দেশ ছাড়ে যায় কিংবা অন্য কোথাও চলে যায় তাহলে তাদের কাছে থাকা খুঁটিগুলো অন্যদের কাছে রেখে যাবে। এখন পর্যন্ত এটা ঘটে নি। তবে ফ্রান্সে যেরকম অস্থিরতা চলছে তাতে মনে হয় যেকোনো সময় এটা ঘটবে। ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ের পক্ষে শার্ল মরিস তয়িরাঁর মতো লোকজনের কড়া নজরদারিতে টিকে থাকা সম্ভব নয়।
“আমি আবারো বলছি,” মরিস জোর দিয়ে বললো মেয়ে দুটোকে চুপ মেরে থাকতে দেখে, “তোমরা মন্তগ্লেইন ছেড়ে এলে কেন?”
“কারণ ওখানকার অ্যাবিটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, মঁসিয়ে।”
“বন্ধ করে দিয়েছে? কিন্তু কেন?”
“চার্চের সম্পত্তি অধিগ্রহণ আইনের কারণে, মঁসিয়ে। অ্যাবিস আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন-”
“আমার কাছে অ্যাবিস যে চিঠি লিখেছিলেন তাতে তিনি বলেছেন পোপের কাছ থেকে নাকি অ্যাবিটা বন্ধ করে দেবার অর্ডার পেয়েছেন,” বললেন ডেভিড।
“আর আপনি সেটা বিশ্বাস করে ফেললেন?” মরিস বললো। “আপনি কি একজন রিপাবলিকান নন? আপনি তো ভালো করেই জানেন ঐ পোপ পায়াস আমাদের বিপ্লবকে নিন্দা করেছেন। আমরা যখন অ্যাসেম্বলিতে বিল এর সি পাস করাই তখন তিনি অ্যাসেম্বলির সব সদস্যকে একমিউনিকেট করার পর্যন্ত দিয়েছিলেন! এই অ্যাবিস মহিলা তো ইতালিয়ান পোপের কাছ থেকে এ অর্ডার পালন করে রষ্ট্রদ্রোহী কাজ করে ফেলেছেন। আপনি কি জানেন ভ্যাটিকান কারা চালায়? জামান রাজপরিবার হাপসবার্গ আর স্পেনিশ বং দল!”
“আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই তোমার মতো আমিও মনেপ্রাণে একজন রিপাবলিকান,” রেগেমেগেই বললেন ডেভিড। “আমার পরিবার কোনো অভিজাত বংশের নয়। আমি একেবারেই সাধারণ একজন নাগরিক। নতুন সরকারের সমস্ত কর্মকাণ্ডের পক্ষে আমি। এই মন্তগ্লেইন অ্যাবি বন্ধ করে দেবার সাথে কোনো রাজনীতি নেই।”
“প্রিয় ডেভিড, এই বিশ্বের সব কিছুর সাথেই রাজনীতি জড়িয়ে আছে। আপনি ভালো করেই জানেন মন্তগ্লেইন অ্যাবির মাটির নীচে কি লুকিয়ে রাখা আছে, জানেন না?” ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। তবে অদ্ভুত চোখে মরিসের দিকে তাকিয়ে নিজের মদের গ্লাসটা তুলে নিলেন ডেভিড।
“আহ্। সেটা তো দাদি-নানিদের কিসসা,” ব্যঙ্গাত্মকভাবে হেসে ফেললেন তিনি।
“তাই নাকি?” বললো মরিস। গাঢ় নীল চোখে দুই বোনকে দেখে যাচ্ছে সে। এরপর মদের গ্লাসটা তুলে নিয়ে কয়েক চুমুক পান করলো, তাকে দেখে মনে হলো উদাস হয়ে গেছে। গ্লাসটা নামিয়ে রেখে কাটাচামচ তুলে আবার খেতে আরম্ভ করলো সে। ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে বরফের মতো জমে আছে, খাবার স্পর্শ করলো না তারা।
“মনে হচ্ছে আপনার ভাতিজিরা খাওয়ার রুচি হারিয়ে ফেলেছে,” মন্তব্য করলো মরিস।
তাদের দুজনের দিকে তাকালেন ডেভিড। “কি হয়েছে? তোমরা আবার আমাকে বোলো না এইসব আজগুবি কাহিনী আসলেই সত্যি!”
“না, আঙ্কেল,” শান্তকণ্ঠে বললো মিরিয়ে। আমরা জানি এটা কুসংস্কার ছাড়া আর কিছু না।”
“অবশ্যই এটি খুব পুরনো একটি কিংবদন্তী, তাই না?” আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেলো মরিস। “তবে একটা কথা নিশ্চয় নিজের কানে শুনেছো তোমরা। আমাকে বলল, তোমাদের ঐ অ্যাবিস মহিলা গেছে কোথায়? এখন তো। মনে হচ্ছে মহিলা পোপের সাথে মিলে ফরাসি সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে, তাই না?”
“ঈশ্বরের দোহাই লাগে, মরিস,” বিরক্ত হয়ে বললেন ডেভিড। “তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি বুঝি ইনকুইজিশন নিয়ে পড়াশোনা করেছে। আমি বলছি ঐ মহিলা কোথায় গেছে, এটা জানার পর ব্যাপারটা এখানেই শেষ করে দিও। সে গেছে রাশিয়ায়।”
কিছুক্ষণ চুপ মেরে থাকলো মরিস। এরপর এমন মুচকি হাসি দিতে লাগলো যেনো মনে মনে বেশ মজার কিছু ভাবছে। “আমারও ধারণা আপনার কথাই ঠিক,” বললো সে। “এবার আমাকে বলুন, আপনার এই ভাতিজিরা কি এখনও প্যারিসের অপেরা দেখার সুযোগ পেয়েছে?”
“না, মঁসিয়ে, হরবর করে বলে ফেললো ভ্যালেন্টাইন। “তবে সেই ছেলেবেলা থেকেই আমাদের স্বপ্ন ছিলো এটা দেখার।”
“তাই নাকি?” হেসে ফেললো মরিস। “তাহলে তো এ ব্যাপারে কিছু একটা করতেই হয়। লাঞ্চের পর তোমাদের ওয়ার্ডরোব দেখবো। ফ্যাশনের ব্যাপারে আমাকে একজন বিশেষজ্ঞ মনে করতে পারো…”
“প্যারিসের অর্ধেক মহিলাকে ফ্যাশনের ব্যাপারে এই মঁসিয়েই উপদেশ দিয়ে থাকে,” বাঁকা হাসি হেসে বললেন ডেভিড।
“পার্টিতে বলডান্স করার জন্যে মেরি আতোয়ানেত্তের চুলের সাজ আমি নিজে করে দিয়েছিলাম, সেই গল্পটা তোমাদেরকে জানানো উচিত। তার পোশাকের ডিজাইনও আমি করেছিলাম। সেই পোশাক পরার পর তার প্রেমিকও তাকে চিনতে পারে নি, আর রাজার কথা না হয় বাদই দিলাম!”
“ওহ আঙ্কেল, আমরা কি বিশপ মঁসিয়েকে আমাদের জন্যেও এসব করতে বলবো?” ভ্যালেন্টাইন অনুনয় করে বললো। আলোচনার বিষয়বস্তু যে বিপজ্জনক ব্যাপার-স্যাপার থেকে ফ্যাশনের মতো পছন্দের বিষয়ে চলে গেছে সেটা ভেবে দারুণ স্বস্তি পেলো সে।