“এবার ভ্যালেন্টাইনের কাপড়টা ঠিক করো তো,” অধৈর্য হয়ে বললেন ডেভিড। “তোমাকে মাচাঙে উঠতে হবে, ঐ যে, ওখানে সিঁড়িটা আছে।”
মরিস খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে মাচাঙে উঠে গেলো। মেঝে থেকে সেটা বেশ কয়েক ফুট উপরে। ভ্যালেন্টাইনের পেছনে দাঁড়ালো সে।
“তাহলে তোমার নাম ভ্যালেন্টাইন?” মেয়েটার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো। “নামটা ছেলেদের হলেও তুমি দেখতে দারুণ সুন্দরী।”
“আর আপনি একদম লুইচ্চা,” চট করে জবাব দিলো ভ্যালেন্টাইন। “বিশপের মতো বেগুনী রঙের কাসোক পরে থাকা একজন লুইচ্চা!”
“ফিসফিসানি বন্ধ করো,” চিৎকার করে বললেন ডেভিড। “কাপড়টা ঠিক করো, মারস! বাইরের আলো শেষ হয়ে যাচ্ছে।” মরিস কাপড়টা সরাতে যাবে ঠিক তখনই ডেভিড বলে উঠলেন, “আহ, মরিস। আমি তোমার সাথে এদের পরিচয় করিয়ে দিতে ভুলে গেছি। এ হলো আমার ভাতিজি ভ্যালেন্টাইন আর তার খালাতো বোন মিরিয়ে।”
“আপনার ভাতিজি!” কাপড়টা পড়ে গেলো মরিসের হাত থেকে, যেনো আগুনের ছ্যাকা খেয়েছে সে।
“আমার দূরসম্পর্কের ভাতিজি,” যোগ করলেন ডেভিড। “তারা আমার অভিভাবকত্বে আছে। তার দাদা ছিলো আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বেশ কয়েক বছর আগে সে মারা গেছে। কাউন্ট দ্য রেমি। আমার বিশ্বাস তোমার পরিবার তাকে চেনে।”
ডেভিডের দিকে বিস্ময়ে চেয়ে রইলো মরিস।
“ভ্যালেন্টাইন, ডেভিড বললেন, “এই ভদ্রলোক ফ্রান্সে খুবই বিখ্যাত একজন লোক। অ্যাসেম্বলির সাবেক প্রেসিডেন্ট। এ হলো মঁসিয়ে শার্ল মরিস দ্য তয়িরাঁ-পেরিগোর্দ। আঁতুয়ার বিশপ…”
মিরিয়ে লাফ দিয়ে মাচাঙ থেকে নেমে পড়লো, কাপড়টা জড়িয়ে নিলো গায়ে। ভ্যালেন্টাইনও একই কাজ করলো সঙ্গে সঙ্গে। তবে সে এমন চিৎকার দিলো যে মরিসের কান ফেঁটে যাবার উপক্রম হলো।
“আঁতুয়ার বিশপ!” মরিসের কাছ থেকে একটু সরে গিয়ে চিৎকার করে বললো ভ্যালেন্টাইন। “শয়তানের চিহ্ন নিয়ে যে লোক জন্মেছে!”
নগ্নপদেই মেয়ে দুটো ঘর থেকে দৌড়ে চলে গেলো।
মুখ টিপে হেসে ডেভিডের দিকে তাকালো মরিস। “বিপরীত লিঙ্গের কেউ সচরাচর আমার সাথে এরকমটি করে না,” বললো সে।
“মনে হচ্ছে তোমার সুখ্যাতি ধীরে ধীরে কমে আসছে,” জবাব দিলেন ডেভিড।
.
স্টুডিওর পাশে ছোট্ট ডাইনিংরুমে বসে জানালা দিয়ে রুই দ্য বাক দেখছেন ডেভিড। মরিস বসে আছে জানালার দিকে পিঠ দিয়ে। তাদের দু’জনের সামনে বিশাল একটি মেহগনি টেবিল। কয়েক বোল ফলমূল আর কিছু মোমবাতি রয়েছে সেটার উপর।
“এরকম প্রতিক্রিয়া কে-ই বা আশা করতে পারে?” বললেন ডেভিড। একটা কমলার কোয়া তুলে নিলেন তিনি। “এরকম ব্যবহারের জন্য আমি ক্ষমা চাইছি। উপর তলায় গিয়েছিলাম, যাইহোক, তারা জামাকাপড় পাল্টে লাঞ্চ করার জন্যে নীচে আসতে রাজি হয়েছে।”
“এটা কি করে হলো, মানে এরকম দুই সুন্দরী তরুণীর অভিভাবক হবার কথা বলছি?” মদের গ্লাসে আস্তে করে চুমুক দিয়ে বললো মরিস। “একজন জানষের পক্ষে এরকম সৌন্দর্য উপভোগ করা একটু বেশিই হয়ে যায় না? তাছাড়া আপনার মতো একজনের সাথে থাকাটা কি অপচয় ছাড়া আর কিছু হচ্ছে?”
ডেভিড মুখ তুলে তাকিয়ে দ্রুত জবাব দিলেন, “আমিও একমত এ ব্যাপারে। তাদেরকে কিভাবে সামলাবো সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণাই নেই। প্যারিসের প্রায় সবখানে ভালো একজন গভর্নেস খুঁজে বেরিয়েছি তাদের শিক্ষাদীক্ষার জন্য। কয়েক মাস আগে আমার বউ আমাকে ছেড়ে ব্রাসেলসে চলে যাবার পর থেকে আমার কাণ্ডজ্ঞানও কমে এসেছে। বুঝতে পারছি না এদের নিয়ে কী করবো।”
“আপনার বউয়ের চলে যাওয়ার কারণ নিশ্চয় এই দু’জন ভাতিজির আগমণ নয়, নাকি?” মুচকি হেসে বললো মরিস।
“মোটেই না,” বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন ডেভিড। “আমার বউ আর তার পরিবার রাজপরিবারের সাথে একটু বেশিই জড়িত ছিলো। অ্যাসেম্বলিতে আমার জড়িত হবার ব্যাপারটা তারা মেনে নিতে পারে নি। তারা মনে করে আমার মতো একজন বুর্জোয়া চিত্রকর, যাকে রাজপরিবার সাপোর্ট দিয়ে এসেছে, তার পক্ষে প্রকাশ্যে বিপ্লবের প্রতি সমর্থন দেয়াটা উচিত হয় নি। বাস্তিল দূর্গ পতনের দিন থেকে আমার বিয়েটা নড়বড়ে হয়ে যায়। আমার বউ দাবি করে আমি যেনো অ্যাসেম্বলি থেকে পদত্যাগ করি, আর সেইসঙ্গে বন্ধ করে দেই রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে ছবি আঁকাআঁকি। এইসব শর্ত মানলেই সে ফিরে আসবে।
“কিন্তু বন্ধু, আপনি যখন রোমে দ্য ওথ অব দি হোরাতু ছবিটা উন্মোচন করলেন তখন লোকজন দল বেধে আপনার পিয়াজ্জা দেল পোপোলো স্টুডিওতে এসে ছবিটার উপর পুস্পবর্ষণ করে গেছে! নতুন রিপাবলিকের ওটা হলো প্রথম মাস্টারপিস, আর আপনি হলেন সেটার চিত্রকর।”
“আমি সেটা জানি কিন্তু আমার বউ জানে না,” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন ডেভিড। “বাচ্চাদেরও ব্রাসেলসে নিয়ে গেছে সে, আমার এই দুই ভাতিজিকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। তবে তাদের অ্যাবিসের সাথে আমার যে শর্ত ছিলো
তাতে করে তাদেরকে প্যারিসে রাখার কথা। এ কাজের জন্যে আমাকে বেশ ভালো পরিমাণের টাকা দেয়া হয়। তাছাড়া এটা তো আমার জন্মস্থান।”
“তাদের অ্যাবিস? আপনার ঐ দুই ভাতিজি নান ছিলো নাকি?” মরিস প্রায় হেসেই ফেলতে যাচ্ছিলো। “কী আজব ব্যাপাররে বাবা! দু দু’জন তরুণীকে, জিশুর নববধূকে কিনা তেতাল্লিশ বছরের এক লোকের হাতে তুলে দেয়া হলো, যার সাথে তাদের রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। ঐ অ্যাবিস কি ভেবে এ কাজ করেছে?”