নিজের বুড়ো আঙুলটা কামড়ালেন ডেভিড। তার ঘন-কালো চুল চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, আর কালো চোখ দুটোতে ঝিলিক দিচ্ছে বন্যতা। হলুদ নীল রঙের স্ট্রাইপের একটি রেশমী কাপড় গলায় পেচিয়ে রেখেছেন তিনি। সেটাতে লেগে আছে চারকোলের গুঁড়ো। পরনের সবুজ রঙের জ্যাকেটটা দুমরেমুচরে আছে।
“আমাকে এখন সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করতে হবে,” অনুযোগের সুরে বললেন তিনি। ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে কোনো কথা বললো না। তাদের মুখ লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠেছে আর বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে চিত্রশিল্পী ডেভিডের পেছনে খোলা দরজার দিকে।
জ্যাক-লুই অধৈর্য হয়ে পেছন ফিরে তাকালেন। লম্বা আর বেশ সুঠাম শরীরের এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে, দেখতে চোখ ধাঁধানো সুন্দর, অনেকটা দেবদূতের মতো। মাথার সোনালী চুল পেছন দিকে টেনে রিবন দিয়ে বাধা। বেগুনি রঙের সিল্কের কাসোক পরে আছে সে।
চোখ দুটো গভীর আর গাঢ় নীল রঙের, চিত্রকরের দিকে নিবদ্ধ সেই চোখজোড়া। অবশেষে তার ঠোঁটে হাসি দেখা গেলো। আশা করি আমি বিরক্ত করছি না,” মাচাঙের উপর দাঁড়িয়ে থাকা দুই তরুণীর দিকে তাকালো সে। তারা হরিণের মতো ভঙ্গি করে পোজ দিয়ে আছে, যেনো এখনই লাফ দেবে। লোকটার কণ্ঠ শুনে মনে হলো উচ্চবংশের কেউই হবে।
“আরে মরিস যে, কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললেন জ্যাক-লুই। “তোমাকে ভেতরে ঢুকতে দিলো কে? তারা তো ভালো করেই জানে কাজের সময় আমি কারো সাথে দেখা করি না।”
আশা করি আপনি এই গ্রীষ্মে আপনার সব লাঞ্চন অতিথিকে এভাবে সম্ভাষণ জানান না, মুচকি হেসে যুবক বললো। “তাছাড়া এটা দেখে আমার কাছে কোনো কাজ বলেও মনে হচ্ছে না। নাকি এটা এমন একটা কাজ যেটাতে আমার হাত লাগানো উচিত।”
ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ের দিকে আবারো তাকালো সে, উত্তর দিকের জানালা দিয়ে আসা সোনালী রোদে তারা স্নাত। স্বচ্ছ কাপড়ের আড়ালে তাদের কম্পমান দেহ তার নজর এড়ালো না।
“মনে হচ্ছে এরকম কাজে তুমি অনেক বেশিই হাত লাগিয়েছে,” বললেন ডেভিড। ইজেল থেকে আরেকটা ব্রাশ তুলে নিলেন তিনি। কিন্তু ভদ্রলোকের মতো-মাচাঙের কাছে গিয়ে কাপড়গুলো আবার ঠিক করে দেবে কি? আমি তোমাকে এখান থেকে নির্দেশ দিচ্ছি কি করতে হবে। সকালের আলো অবশ্য এরইমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। আর বিশ মিনিট পরই আমরা লাঞ্চের জন্যে বিরতি নেবো।”
“আপনার স্কেচটা কি?” যুবক জানতে চাইলো। মাচাঙের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় দেখা গেলো এক পা টেনে টেনে হাটছে।
“চারকোল আর ওয়াশের,” জবাব দিলেন ডেভিড। “অনেক দিন ধরে এই আইডিয়াটা নিয়ে ভেবে গেছি, পুশিনের দ্য রেইপ অব অ্যা স্যানিন উইমেন-এর থিম।”
“কী দৃষ্টিনন্দন ভাবনারে বাবা,” মাচাঙের কাছে যেতে যেতে বললো মরিস। আমি কাপড়গুলো কি করবো? দেখে তো বেশ লাগছে।”
ভ্যালেন্টাইন দাঁড়িয়ে আছে মরিসের মাথার উপর মাচাঙে, তার এক হাটু সামনে বাড়িয়ে রাখা আর হাত দুটো দুদিকে প্রসারিত। তার পাশেই আছে মিরিয়ে, হাটু মুড়ে হাত দুটো সামনের দিকে বাড়িয়ে রেখেছে অনুনয়ের ভঙ্গিতে। তার ঘন লালচে চুল কাঁধের উপর দিয়ে সামনের দিকে ছড়িয়ে আছে, তবে নগ্ন বক্ষ ঢেকে রাখতে পারছে না সেগুলো।
“ঐ যে লালচুলগুলো, একটু সরিয়ে দাও,” দূর থেকে চোখ কুচকে বললেন ডেভিড। “না, এতোটা না। শুধু বাম স্তনটা যাতে ঢেকে যায় এমনভাবে সরিয়ে দাও। ডান স্তনটা পুরোপুরি উন্মুক্ত থাকবে। একেবারে উন্মুক্ত। কাপড়টা আরেকটু নামিয়ে দাও। তারা সৈনিকদের প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছে, বুঝলে, কোনো সতী-সাধ্বী নান নয় তারা।
যেভাবে বলা হলো সেভাবেই কাজ করলো মরিস কিন্তু বুকের কাছে কাপড়টা সরাতে গেলে তার হাত কেঁপে উঠলো।
“সরাও। আরেকটু সরাও, ঈশ্বরের দোহাই লাগে, আমি যেনো স্তনটা দেখতে পাই। আরে এখানে চিত্রকর কে, বলি?” চিৎকার করে বললেন ডেভিড।
মরিস একটা দিক সরিয়ে দূর্বল হাসি দিলো। জীবনে সে এতো সুন্দরী তরুণী দেখে নি। মনে মনে ভাবলো, ডেভিড এদের কোত্থেকে খুঁজে পেয়েছে। এই সমাজের সবাই জানে মহিলারা তার স্টুডিওর সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ডেভিডের তুলির আঁচড়ে গ্রিক ফেমে ফাটাল হবার জন্য। কিন্তু এই মেয়ে দুটো একেবারে আনাড়ি আর গ্রাম্য, প্যারিসের অভিজাত নারী বলে মনে হয় না।
প্যারিসের যে কোনো পুরুষের চেয়ে এই সমাজের নারীদের স্তন আর উরু অনেক বেশি হাতিয়েছে মরিস। তার শয্যাসঙ্গিনীদের মধ্যে ডাচেস দ্য লুইনেস, ডাচেস দ্য ফিজ-জেমস, ভিকোমতে দ্য লাভাল এবং প্রিন্সেস দ্য ভদেমোয় রয়েছে। এটা তার এমন একটি ক্লাব যেখানে সদস্য হবার জন্য সব সময়ই দরজা খোলা থাকে।
মরিসের বয়স সাইত্রিশ হলেও তাকে দশ বছর কম দেখায়। আর নিজের এই তারুণ্যকে সে বিশ বছর ধরে দারুণভাবে সদ্ব্যবহার করে আসছে। এই সময়ের মধ্যে পন্ত নুয়েফ দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে, যার পুরোটাই উপভোগের কাজে ব্যয় করেছে সে। তার শয্যাসঙ্গিনীরা তার জন্যে সব সময়ই দরজা খোলা রাখে। শুধু যৌনতাই নয়, তার জন্যে তারা অনেক কিছুই করেছে।
অন্য যে কারো চেয়ে মরিস ভালো করেই জানে, ফ্রান্স চালায় নারীরা। সে মনে করে আইনগতভাবে নারীদের জন্যে সিংহাসন আরোহন নিষিদ্ধ থাকার কারণেই মেয়েরা তাদের ক্ষমতা চরিতার্থ করে অন্যভাবে। তারাই সিংহাসনে বসায় তাদের পছন্দের প্রার্থীকে।