গণক মহিলা এবার ক্লিপবোর্ডের দিকে তাকিয়ে কী যেনো ভেবে নিলো। আমার খুব বিরক্ত লাগছে। এই ককটেল লাউঞ্জের ভবিষ্যদ্বক্তা আমাকে ভড়কে দেবার চেষ্টা করছে কেন? হঠাৎ করে মহিলা আমার দিকে তাকালো। আমার রাগ আর বিরক্তি টের পেয়েছে সে। এবার বেশ পেশাদারদের মতো আচরণ করলো।
“আপনি ডান-হাতি,” বললো মহিলা। “বাম হাতেই আপনার নিয়তি লেখা আছে। যে নিয়তি নিয়ে আপনি জন্মেছেন। ডান হাত বলছে নতুন কোনো জায়গায় যাচ্ছেন। প্রথমে আপনার বাম হাতটা দিন।”
আমি স্বীকার করছি এটা অদ্ভুতই বটে, তবে সে যখন আমার বাম হাতের দিকে নিঃশব্দে চেয়ে রইলো তখন গা শিউড়ে ওঠার মতো অনুভূতি হলো, মনে হলো মহিলা আসলেই কিছু দেখতে পাচ্ছে। তার দূর্বল আর শুকনো হাতটা যখন আমার হাত ধরলো টের পেলাম বরফের মতোই শীতল সেটা।
“বাহবা,” অদ্ভুত কণ্ঠে বললো সে। “একটা হাতই বটে, আপনার।”
আমার হাতের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইলো মহিলা, চশমার পেছনে তার চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেলো। তার হাত থেকে ক্লিপবোর্ডটা মেঝেতে পড়ে গেলেও কেউ সেটা তুললো না। আমাদের টেবিলে উত্তেজনা বিরাজ করলেও কেউ মুখ ফুটে কিছু বলছে না। সবাই আমাকে দেখছে, আর ঘরের ভেতর আমাদের চারপাশে চলছে হৈহল্লা।
মহিলা গণক দু’হাতে আমার হাতটা শক্ত করে ধরলে হাতে ব্যথা পেতে লাগলাম। হাতটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলেও পারলাম না। মহিলা যেনো লোহার আঙটা দিয়ে আটকে রেখেছে সেটা। কোনো এক কারণে অযৌক্তিকভাবেই আমি রেগে গেলাম। এগনগ আর ফলের জুস খেয়ে আমার একটু অস্বস্তিও লাগছিলো। ডান হাতটা ব্যবহার করে বাম হাতটা মহিলার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম।
“আমার কথা শুনুন,” একেবারে অন্য রকম এক কণ্ঠে কথাটা বললো মহিলা। এখানে আসার পর তার যে কণ্ঠ শুনেছি তার চেয়ে অনেক আলাদা। বুঝতে পারলাম তার বাচনভঙ্গি আমেরিকানদের মতো নয়, তবে ঠিক কোথাকার ধরতে পারলাম না। মাথার ধূসর চুল আর কুজো হবার কারণে মনে হয়েছিলো তার বয়স অনেক বেশি, তবে এখন মনে হচ্ছে মহিলা যথেষ্ট লম্বা আর গায়ের চামড়ায় কোনো ভাঁজ নেই। আমি আবারো কথা বলতে শুরু করতেই হ্যারি তার চেয়ার ছেড়ে বিশাল দেহটা নিয়ে আমাদের কাছে এসে দাঁড়ালো।
“এটা আমার জন্যে অনেক বেশি মেলোড্রামাটিক হয়ে যাচ্ছে, গণকের কাঁধে হাত রেখে বললো সে। অন্য হাতে পকেট থেকে আরো কিছু টাকা বের করে মহিলার দিকে বাড়িয়ে দিলো। “এটাকে একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাই, কি বলেন?” গণক তাকে আমলেই নিলো না, আমার দিকে আরো ঝুঁকে এলো সে।
“আমি আপনাকে সাবধান করে দিতে এসেছি,” ফিসফিসিয়ে বললো। মহিলা। “যেখানেই যান না কেন পেছনে তাকিয়ে দেখবেন। কাউকে বিশ্বাস করবেন না। সবাইকে সন্দেহ করবেন। আপনার হাতের রেখা বলছে…এই হাতটার ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করা আছে।”
“কে করেছে?” জানতে চাইলাম আমি।
আমার হাতটা আবারো তুলে নিয়ে আলতো করে হাতে রেখায় পরশ বুলিয়ে গেলো চোখ বন্ধ করে। যেনো অন্ধ কেউ ব্রেইলি পড়ছে। এখনও ফিসফিসিয়ে কথা বলছে যেনো স্মরণ করছে বহু দিন আগে শোনা কোনো কবিতা।
“এই যে রেখাটা, যেটা চাবির মতো আকৃতি ধারণ করেছে, এটা হলো দাবার বর্গ, যখন চতুর্থ মাসের চতুর্থ দিন আসবে তখন রাজার চাল দিতে ঝুঁকি নেবেন না। একটা খেলা আসল, আর অন্যটা রূপকার্থে। অকথিত সময়, এই প্রজ্ঞা অনেক দেরি করে এসেছে। সাদার যুদ্ধ বিরামহীনভাবেই দামামা বাজাচ্ছে। সব জায়গায় কালোরা তার ভাগ্য চুরি করতে উঠে পড়ে লেগেছে। তেত্রিশ আর তিনের খোঁজ অব্যাহত রাখুন। চিরন্তন আড়াল হলো গোপন দরজা।”
তার কথা যখন শেষ হলো তখন আমি নিশ্চুপ, হ্যারি পকেটে হাত ঢুকিয়েই দাঁড়িয়ে আছে। মহিলা কী বোঝাতে চাচ্ছে সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণাই নেই-তবে ব্যাপারটা যে অদ্ভুত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মনে হচ্ছে এখানে, এই বারে, এই কথাগুলো আগেও আমি শুনেছি। ব্যাপারটাকে দেজাভু মনে করে কাঁধ ঝাঁকালাম।
“আপনি কি বলছেন কিছুই বুঝতে পারছি না, খুব জোরেই বললাম কথাটা।
“আপনি বুঝতে পারছেন না?” মহিলা বললো। অদ্ভুত ব্যাপার হলো আমার দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিলো সে। “তবে বুঝতে পারবেন,” জোর দিয়ে বললো গণক। “চতুর্থ মাসের চতুর্থ দিন? এটা কি আপনার কাছে কিছু ইঙ্গিত করছে না?”
“হ্যাঁ, কিন্তু—”
মহিলা তার ঠোঁটে আঙুল রেখে মাথা ঝাঁকালো। “এর মানে কি সেটা আপনি কাউকে বলবেন না। একদম না। বাকিটা খুব জলদিই বুঝতে পারবেন। যেহেতু এই হাতটাই ভবিষ্যত্বাণী করা হয়েছে। নিয়তির হাত। এটা লেখা হয়ে গেছে-চতুর্থ মাসের চতুর্থ দিন, তারপরই আসবে আট। “
“মানে কি?” লিউলিন আৎকে উঠে বললো। টেবিলের কাছে এসে মহিলার হাতটা খপ করে ধরে ফেললো সে, কিন্তু মহিলা ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নিলো তার হাত।
ঠিক তখনই পুরো ঘরটা অন্ধকারে ডুবে গেলো। হৈহল্লা করতে থাকা লোকগুলো হর্ন বাজাতে শুরু করলো একসঙ্গে। শ্যাম্পেইনের বোতলের ছিপি খোলার শব্দ শুনতে পেলাম আমি। সবাই চিৎকার করছে সমস্বরে, “হ্যাপি নিউ ইয়ার!” রাস্তায় পটকা আর আতশবাজি ফুটতে শুরু করলো। নিভু নিভু ফায়ারপ্লেসের সামনে থাকা পার্টিবাজ লোকগুলোর কালচে অবয়ব দেখে মনে হচ্ছে দান্তের দেখা নরকের কৃষ্ণ-প্রেতাত্মা। তাদের চিৎকার অন্ধকারে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।