ঐ সময় জারিনা এলিজাবেথ পেত্রোভানার সাথে দেখা করার জন্য মস্কোতে চলে যাই আমি। এলিজাবেথ ছিলেন পিটার দ্য গ্রেটের কন্যা, তিনি রাজনৈতিক কু করে ক্ষমতা দখলে নিয়ে সমস্ত বিরোধীদেরকে বন্দী করে রেখেছিলেন জেলখানায়। যেহেতু তিনি বিয়েথা করেন নি, আর বাচ্চা নেবার মতো বয়সও। পেরিয়ে গিয়েছিলো তাই নিজের উত্তরাধিকার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তার রহস্যময় ভাতিজা গ্র্যান্ড ডিউক পিটারকে। আমি তারই স্ত্রী হতে যাচ্ছিলাম।
রাশিয়ায় যাবার পথে আমি আর আমার মা বার্লিনে দ্বিতীয় ফ্রেডারিকের রাজদরবারে বিরতি নেই। প্রুশিয়ার তরুণ সম্রাট ফ্রেডারিক, ভলতেয়ার যাকে ‘মহান’ বলে অভিহিত করেছিলেন, তিনি চাইছিলেন বিয়ের মাধ্যমে রাশিয়া আর প্রুশিয়ার একত্রিকরণ করতে, আর সেই কাজ করার জন্যেই পেতে চাইছিলেন আমাকে। ফ্রেডারিকের নিজের বোনের চেয়ে আমি ছিলাম অধিকতর পছন্দের, কারণ তিনি তার বোনকে এরকম ভাগ্যের কাছে বলি দিতে পারছিলেন না।
ঐ সময়টাতে প্রশিয়ান রাজদরবারে অসংখ্য মেধাবী লোকজন ছিলো। আমি ওখানে যাওয়ামাত্র ম্রাট আমাকে মুগ্ধ করার জন্য সাধ্যমতো অনেক কিছুই করেছিলেন। তিনি তার বোনদের গাউন আমাকে পরতে দিলেন, প্রত্যেক রাতে ডিনারের সময় নিজের পাশে বসাতেন আমাকে, অপেরা আর ব্যালের গল্প বলে আমাকে আমোদিত করতেন। আমার বয়স অনেক কম হলেও আমি এসবে বিমোহিত হই নি। ভালো করেই জানতাম বিরাট একটা খেলায় তিনি আমাকে দাবার ঘুটি হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন। এটা এমন একটা খেলা যা খেলা হবে ইউরোপ নামক একটি দাবাবোর্ডে।
কিছুদিনের মধ্যেই আমি জানতে পারলাম প্রুশিয়ান রাজদরবারে এমন একজন ব্যক্তি রয়েছেন যিনি দশ বছর রাশিয়ায় থেকে ফিরে এসেছেন। তিনি ছিলেন সম্রাট ফ্রেডারিকের সভা-গণিতজ্ঞ, তার নাম লিওনহার্ড ইউলার। আমি বেশ সাহসের সাথেই অনুরোধ করলাম তার সাথে একান্তে কিছু সময় কাটাতে চাই, জানতে চাই সেই দেশটা সম্পর্কে যেখানে খুব শীঘ্রই আমি আমার নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছি।
আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয় বার্লিনের রাজদরবারের ছোট্ট একটি কক্ষে। এই সাদাসিধে আর অসাধারণ পণ্ডিত লোকটি এমন এক অল্পবয়সী মেয়ের সাথে পরিচিত হলেন যে খুব শীঘ্রই রাণী হতে যাচ্ছে। উনি ছিলেন বেশ লম্বা আর হালকাঁপাতলা গড়নের, একজোড়া কালো গভীর চোখ আর তীক্ষ্ণ নাক। আমার দিকে কেমন এক পাশ ফিরে তাকালেন। বললেন, সূর্য পর্যবেক্ষণ করতে করতে তার একচোখ অন্ধ হয়ে গেছে। ইউলার নিজে গণিতজ্ঞের পাশাপাশি একজন জ্যোতির্বিদও ছিলেন।
“কথা বলার ব্যাপারে আমি খুব একটা অভ্যস্ত নই,” তিনি বলতে শুরু করলেন। “আমি এমন একটি দেশ থেকে এসেছি যেখানে কথা বললে আপনাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়।” এ হলো রাশিয়া সম্পর্কে আমার প্রথম জ্ঞানলাভ। তোমাকে আশ্বস্ত করে বলতে পারি, পরবর্তী সময়ে এটা আমাকে বেশ ভালো কাজে দিয়েছিলো। তিনি আমাকে বলেছিলেন, জারিনা এলিজাবেথ পেট্রোভানার পনেরো হাজার পোশাক আর পঁচিশ হাজার জোড়া জুতো রয়েছে। তিনি যদি কখনও তার মিনিস্টারদের সাথে কোনো রকম দ্বিমত পোষণ করেন কিংবা কারো কথা অপছন্দ করেন তখন তার মাথা লক্ষ্য করে জুতো ছুঁড়ে মারেন, সঙ্গে সঙ্গে ঝুলিয়ে দেন ফাঁসিকাষ্ঠে। তার প্রেমিকেরা প্রায় সবাই সেনাবাহিনীর লোক। সম্রাজ্ঞির যৌনতার চেয়ে মদ্যপান চলে আরো অধিকহারে। নিজের মতের বিরুদ্ধে কোনো মতামত তিনি সহ্য করতে পারেন না।
প্রাথমিক জড়তা কেটে যাবার পর ডক্টর ইউলার আর আমি প্রচুর সময় কাটিয়েছি। আমরা একে অন্যকে বেশ পছন্দও করতে শুরু করি। তিনি স্বীকার করেন, আমাকে বার্লিন রাজসভায় গণিতের একজন ছাত্রি হিসেবে রেখে দিতে উদগ্রীব। তার মতে গণিতে নাকি আমি অনেক ভালো করবো। অবশ্য এটা করা তখন আমার পক্ষে অসম্ভব ছিলো।
ইউলার এও স্বীকার করেন, তিনি তার পৃষ্ঠপোষক সম্রাট ফ্রেডারিককে খুব একটা পাত্তা দেন না। ফ্রেডারিকের দূর্বল গণিতজ্ঞান ছাড়াও অনেক সঙ্গত কারণ। ছিলো। বার্লিনে আমার শেষদিনে ইউলার তার কারণটা আমাকে জানিয়েছিলেন।
“আমার ছোট্ট বন্ধু, তাকে বিদায় জানাতে তার ল্যাবরেটরিতে ঢুকতেই তিনি আমায় বললেন। আমার মনে আছে তিনি সিল্কের কাপড় দিয়ে একটা লেন্স পলিশ করছিলেন। “চলে যাবার আগে আপনাকে একটা কথা বলা দরকার। বিগত কয়েক দিনে আমি আপনাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। আমি বিশ্বাস করি এখন যা বলবো সে ব্যাপারে আপনার উপর আস্থা রাখা যায়। আপনি যদি এই কথাগুলো কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে প্রকাশ করে দেন তাহলে আপনার আমার দু’জনের জীবনই মারাত্মক বিপদে পড়ে যাবে।”
আমি আপনাকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই ডক্টর ইউলার, নিজের জীবন দিয়ে হলেও আমি আপনার কথাটা হেফাজত করবো। এরপর আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন সেটার হয়তো দরকার হতে পারে।
“আপনার বয়স অনেক কম, আপনি ক্ষমতাহীন, তার উপর আপনি একজন নারী,” বললেন ইউলার। এসব কারণেই ফ্রেডারিক অপসাম্রাজ্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে আপনাকে নির্বাচন করেছে তার একটি হাতিয়াড় হিসেবে। সম্ভবত আপনি জানেন না এই দেশটি বিগত বিশ বছর ধরে অসাধারণভাবেই নারী কর্তৃক শাসিত হয়ে আসছে : প্রথমে পিটার দ্য গ্রেটের বিধবা স্ত্রী প্রথম ক্যাথারিন; তারপর আইভানের মেয়ে অ্যানা আইভানোভনা; অ্যানা মেকলেনবার্গ, যিনি তার নিজের সন্তান ষষ্ঠ আইভানের কাছ থেকে ভারপ্রাপ্ত সম্রাজ্ঞি হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। আর এখন ক্ষমতায় আছেন পিটারের কন্যা এলিজাবেথ পেত্রোভনা। আপনি যদি এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন তাহলে নিজেকে মারাত্মক বিপদের মধ্যে নিপতিত করবেন।”