বুঝতেই পারছো, হ্যারি এটা খুব পছন্দ করেছে,” হেসে বললো ব্লাঁশে।
“মহিলা বলেছে জীবনের খেলায় সৈন্যরা হলো হৃদস্পন্দন, আর অন্য কোনো মহিলা যদি সাহায্য করে তাহলে রাজা তার চাল বদলাতে পারবে। আমার মনে হয় সে তোমার কথাই বলেছে-”
“মহিলা বলেছে ‘দাবার সৈন্যরা হলো দাবার প্রাণ,’” কথার মাঝখানে বললো ব্লাঁশে। “আমার ধারণা এটা একটা কোটেশন…”
“এটা তোমার মনে থাকলো কিভাবে?” বললো হ্যারি।
“কারণ লিউ এখানকার ককটেল রুমালে ঐ মহিলার সব কথা লিখে রেখেছে,” জবাব দিলো রাশে। “জীবনের বেলায় সৈন্যরা হলো দাবার প্রাণ। এমনকি তুচ্ছ কোনো সৈন্যও বিরাট পরবির্তন ঘটাতে সক্ষম। তুমি ভালোবাসো এম কেউ স্রোতের দিক বদলে দিতে পারে এবং সে-ই বয়ে আনবে সমাপ্তি। এটাই আগাম বলা হয়েছে।” ব্লাঁশে রুমালটা নামিয়ে রেখে এক চুমুক শ্যাম্পেইন পান করলো আমাদের দিকে না তাকিয়েই।
“বুঝলে তো? খুশি হয়ে বললো হ্যারি। “আমি এটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছি-তুমি কোনো অলৌকিক কাজ করে দেখাবে-লিলি কিছু দিনের জন্যে দাবার নেশা থেকে দূরে থাকবে, স্বাভাবিক জীবন যাপন করবে।”
“তোমার জায়গায় আমি হলে নিঃশ্বাস আটকে রাখতাম না,” শীতল কণ্ঠে বললো ব্লাঁশে।
ঠিক তখনই গণককে নিয়ে হাজির হলো লিউলিন। হ্যারি উঠে সরে বসলো গণককে আমার পাশে বসতে দেয়ার জন্য। তাকে দেখে প্রথমেই মনে হলো আমার সাথে বুঝি তামাশা করা হচ্ছে। মহিলা আপাদমস্তক কিম্ভুতকিমাকার। একেবারে খাঁটি অ্যান্টিক সামগ্রী। কুজো হয়ে আছে। মাথার ফোলানো ফাপানো চুলগুলো দেখে মনে হচ্ছে উইগ, বাদুরের ডানার মতো দেখতে চশমা পরে আছে সে। চশমার ফ্রেমে ছোটো ছোটো পাথর বসানো। সেই চশমার উপর দিয়ে আমার দিকে তাকালো মহিলা। এম্ব্রয়ডারি করা গোলাপী রঙের উলের সোয়েটার পরে আছে, আর ট্রাউজার হিসেবে যে সবুজ রঙের জিনিসটা পরেছে সেটা একেবারে ঢিলেঢালা। মনে হয় না এটা তার সাইজের। সূতো দিয়ে ‘মিমসি’ লেখা এক জোড়া গোলাপী রঙের জুতো পরেছে মহিলা। তার হাতে একটা ক্লিপবোর্ড, মাঝেমধ্যেই ওটার দিকে তাকাচ্ছে। বিরামহীণভাবে চিবিয়ে যাচ্ছে চুইংগাম।
“এই আপনার বন্ধু?” বাজখাই চড়া গলায় বললো মহিলা। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে মহিলার হাতে কিছু টাকা তুলে দিলো হ্যারি। টাকাগুলো ক্লিপবোর্ডে আটকে রেখে আমার পাশে বসলো সে। হ্যারি তার বিপরীতে একটা সিটে গিয়ে বসলে আমার দিকে তাকালো মহিলা।
“ডার্লিং, উনার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে মাথা নেড়ে জানিও,” বললো হ্যারি। “তাহলে উনার পক্ষে তোমার…”
“আচ্ছা, ভাগ্য গণনাটা কে করবে?” বৃদ্ধমহিলা রেগেমেগে বললো। এখনও আমাকে চশমার উপর দিয়ে দেখে যাচ্ছে। আমার পাশে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো সে, কোনো ভাগ্য গণনা করলো না। তার মধ্যে কোনো তাড়া দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর সবাই অধৈর্য হয়ে উঠলো।
“আপনার কি আমার হাত দেবার কথা না?” জানতে চাইলাম।
“তুমি কেনো কথা বলবে না!” হ্যারি আর লিউলিন একসাথে বললো।
“সবাই চুপ করুন!” বিরক্ত হয়ে বললো গণক। এটা খুব কঠন সাবজেক্ট। আমি মনোসংযোগ করার চেষ্টা করছি।
আসলেই মহিলা মনোসংযোগ করছে, ভবলাম আমি। এখানে আসার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও আমার উপর থেকে চোখ সরায় নি। হ্যারির হাতঘড়ির দিকে চকিতে তাকালাম। বারোটা বাজতে আর সাত মিনিট বাকি। গণক একদম নড়ছে না। মনে হচ্ছে পাথর হয়ে গেছে।
বারোটা বাজতেই ক্ষেপে উঠলো ঘরের লোকজন। তাদের কণ্ঠস্বর চড়ে গেলো, শোনা যেতে লাগলো শ্যাম্পেইনের বোতল খোলার শব্দ। পকেট থেকে দেখতে হাস্যকর টুপি বের করে পরতে শুরু করলো একেকজন। মাথার উপর আছড়ে পড়তে লাগলো রঙ বেরঙের কনফেত্তি। পুরনো বছরের সমস্ত চাপ আর ক্লান্তি যেনো বিস্ফোরিত হয়ে ফুরিয়ে যেতে লাগলো এক লহমায়। মনে পড়ে গেলো কেন আমি নিউইয়ার্স ইভের সময় বাইরে যাওয়াটা সব সময় এড়িয়ে চলি। গণককে দেখে মনে হলো চারপাশের লোকজনের কথা বেমালুম ভুলে গেছে। চুপচাপ বসে একদৃষ্টে চেয়ে আছে আমার দিকে।
মুখ ফিরিয়ে মহিলার দৃষ্টি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলাম। হ্যারি আর লিউলিন উদগ্রীব হয়ে আছে। ব্লাঁশে মহিলার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে চুপচাপ। কিছুক্ষণ পর যখন মহিলার দিকে তাকালাম দেখতে পেলাম এখনও আমার দিকেই চেয়ে আছে। মনে হলো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আছে সে। যেনো আমার ভেতরটা দেখতে পাচ্ছে। এরপর আস্তে আস্তে আমার চোখের দিকে ফোকাস করলে সঙ্গে সঙ্গে আমার মধ্যে একটি অস্বস্তিকর অনুভূতি বয়ে গেলো, ঠিক যেমনটি ঘটেছিলো একটু আগে। তবে এবার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা আমার ভেতর থেকে উদ্ভূত হয়েছে।
“কথা বলবেন না,” আচমকা ফিসফিস করে গণক মহিলা আমাকে বললো। কথাটা যে মহিলা বলেছে সেটা বুঝতে আমার কিছুটা সময় লেগে গেলো। হ্যারি আর লিউলিন আরো ঝুঁকে এলো মহিলার কথা ভালোমতো শোনার জন্য।
“আপনি ভয়ঙ্কর বিপদে পড়ে গেছেন,” বললো গণক মহিলা। “আমি চারপাশে বিপদের গন্ধ পাচ্ছি।”
“বিপদ?” চমকে উঠে বললো হ্যারি। ঠিক এ সময় বরফ আর শ্যাম্পেইন নিয়ে এক ওয়েটার হাজির হলে সে বিরক্ত হয়ে হাত নেড়ে ওগুলো টেবিলে রেখে দ্রুত চলে যেতে বললো তাকে। “আপনি কিসের কথা বলছেন? এটা কি কোনো ঠাট্টা?”