পুরো দৃশ্যটা আমার কাছে অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে। পোস্টকার্ডে দেখা কোনো দৃশ্য। ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে। লোকজনে ভর্তি একটা বার। কাঁচের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরই হ্যারি বাইরে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
“ডার্লিং!” বিশাল দেহের হ্যারি লম্বায় ছ’ফুট চার-পাঁচ ইঞ্চির মতো হবে, মোটাসোটা হবার দরুণ দেখতে দৈত্যের মতো লাগে। লাল-সবুজ রঙের ডিনার জ্যাকেট পরে আছে বলে আরো বেশি দৈত্যাকার লাগছে তাকে।
“তুমি এসেছো বলে আমি খুব খুশি হয়েছি,” আমাকে ছেড়ে দিয়ে হাত ধরে লবিতে নিয়ে এলো এবার।
“ডিয়ার, ডিয়ার ক্যাট,” বলেই লিউলিন নিজের আসন থেকে উঠে আমার গালে আলতো করে চুমু খেলো। “ব্লাঁশে আর আমি ভাবছিলাম তুমি আসলেই আসবে কিনা, তাই না ডিয়ারেস্ট?”
লিউলিন সব সময়ই ব্লাঁশেকে ডিয়ারেস্ট বলে ডাকে, এ নামে লিটল লর্ড ফন্টলিরয় তার মাকে ডাকতো।
“সত্যি বলছি, ডার্লিং, তোমাকে কম্পিউটারের সামনে থেকে দূরে রাখাটা এ দুনিয়ার সবচাইতে কঠিনতম কাজ,” বললো সে। “কসম খেয়ে বলছি, হ্যারি আর তোমার যদি কোনো কাজ না থাকতো তাহলে তোমরা কী যে করতে প্রতিদিন!”
“হ্যালো, ডার্লিং,” ব্লাঁশে কথাটা বলেই আমাকে উপুড় হবার জন্য ইশারা করলো যাতে করে তার মসৃণ গালের সাথে আমার গালটা ছোঁয়া যায়। “সব সময়ের মতো আজকেও তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। বসো। হ্যারি তোমার জন্য কি ড্রিং অর্ডার দেবে?”
“আমি তার জন্য এগনগ নিয়ে আসছি,” বললো হ্যারি। আমাদের দিকে এমন আমুদে ভঙ্গিতে তাকালো যে মনে হলো সে বুঝি জীবন্ত কোনো ক্রিসমাস ট্রি। “এখানে দারুণ এগনগ পাওয়া যায়। একটু খেয়ে দেখো, তারপর তোমার যা খুশি খেতে পারো।” কথাটা বলেই লোকজনের ভীড় ঠেলে চলে গেলো বারের দিকে।
“হ্যারি বলছিলো তুমি নাকি ইউরোপে যাচ্ছো?” আমার পাশে বসতে বসতে লিউলিন বললো। ব্লাঁশেকে তার ড্রিং বাড়িয়ে দিলো সে। তারা দু’জনেই ম্যাচ করে পোশাক পরেছে। ব্রাশে পরেছে গাঢ় সবুজ রঙের সান্ধ্যকালীন গাউন আর লিউলিন পরেছে গাঢ় সবুজ রঙের ভেলভেটের জ্যাকেট। তারা দু’জনেই মধ্য চল্লিশের হলেও দেখতে একেবারে তরুণ দেখায়।
“ইউরোপে নয়,” জবাবে বললাম আমি। “আলজিয়ার্সে। এটা একধরণের শাস্তি। আলজিয়ার্স হলো আলজেরিয়ার”।
“আমি জানি সেটা কোথায়,” বললো লিউলিন। সে এবং ব্লাঁশে দৃষ্টি বিনিময় করলো। কিন্তু কী দারুণ কাকতালীয় ব্যাপার, তাই না, ডিয়ারেস্ট?
“তোমার জায়গায় আমি হলে এ কথাটা হ্যারিকে বলতাম না,” কানের দুলে হাত বোলাতে বোলাতে বললো ব্লাঁশে। “ও একেবারে আরববিদ্বেষী। তারপরও বলবে এগিয়ে যাও।”
“তুমি এটা উপভোগ করতে পারবে না,” বললো লিউলিন। “ভয়ঙ্কর একটি জায়গা। দারিদ্র, নোংরা, তেলাপোকা। খাবার-দাবারের অবস্থা আরো খারাপ।”
“তোমরা কি ওখানে গিয়েছিলে কখনও?” জানতে চাইলাম আমি, লিউলিন যে আমার আসন্ন নিবাসনস্থলের ব্যাপারে অনেক কিছু জানে সেজন্যে কিছুটা খুশি হলাম।
“আমি যাই নি,” বললো সে। “তবে আমার হয়ে ওখানে কেউ গিয়ে ঘুরে আসুক সেটা আমি চাচ্ছিলাম অনেক দিন ধরে। আমার এখন মনে হচ্ছে অবশেষে একজনকে পেয়ে গেছি। তুমি হয়তো জানো আমি মাঝেমধ্যেই আর্থিক ব্যাপারে হ্যারির উপর নির্ভর করি…”
হ্যারির কাছে লিউলিনের ঋণের বোঝা কতোটুকু সেটা আমার চেয়ে আর কেউ বেশি জানে না। যদিও হ্যারি এ নিয়ে খুব একটা মুখ খোলে না কখনই। তবে ম্যাডিসন এভিনুতে লিউলিনের অ্যান্টিকশপের করুণ অবস্থা দেখে ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তার শপটা দেখতে পুরনো-গাড়ি বিক্রির দোকান বলে মনে হয়।
“তবে এখন,” লিউলিন বললো, “আমি একজন কাস্টমার পেয়েছি যে দুর্লভ জিনিস সংগ্রহ করতে চায়। সে কি খুঁজছে সেটা যদি আমি জোগার করে দিতে পারি তাহলে স্বনির্ভরতার টিকেট হাতে পেয়ে যাবো।”
“তুমি বলতে চাচ্ছো ঐ লোক যা পেতে চাইছে সেটা আলজেরিয়াতে আছে?” ব্লাঁশের দিকে চেয়ে বললাম। একমনে শ্যাম্পেইনে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে। সে, মনে হয় না আমাদের কথাবার্তা তার কানে গেছে। “আমি যদি সেখানে যাইও তিনমাস পরে যাবো। ভালো কথা, তুমি নিজে কেন যাচ্ছে না, লিউলিন?”
“ব্যাপারটা অতো সহজ নয়,” বললো সে। “ওখানে আমার যে কন্ট্যাক্ট আছে সে একজন অ্যান্টিক ডিলার। সে জানে জিনিসটা কোথায় আছে, তবে সেটা কিনতে পারছে না। জিনিসটার মালিক নিভৃতচারি। এরজন্য একটু প্রচেষ্টা আর সময় দরকার। ওখানে বসবাস করছে এরকম কারো পক্ষেই কাজটা করা বেশি সহজ…”।
“তুমি তাকে ছবিটা দেখাচ্ছো না কেন, শান্তকণ্ঠে বললো ব্লাঁশে। লিউলিন রাশের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বুকপকেট থেকে একটা দোমড়ানো মোচড়ানো রঙ্গিন ছবি বের করলো। দেখে মনে হচ্ছে কোনো বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে ছেঁড়া হয়েছে। ছবিটা সমান করে টেবিলের উপর রাখলো সে।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে হাতির দাঁতে তৈরি অথবা রঙ্গিন কাঠ খোদাই করে করা একটি ভাস্কর্য-হাতির পিঠে সিংহাসনে বসা এক লোক। হাতির পেছনে বেশ কয়েকজন পদাতিক সৈন্য। হাতির পায়ের চারপাশে মধ্যযুগের অস্ত্র হাতে কয়েকজন অশ্বারোহী। খুবই সূক্ষ্ম নক্সা, অবশ্যই বেশ পুরনো। আমি জানি না এটার কী এমন গুরুত্ব আছে তবে ছবিটা দেখেই আমার মধ্যে অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। টেবিলের পাশে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম।