“ব্ল্যাক কুইন,” ক্যাথারিনের ভাবভঙ্গি লক্ষ্য করে বললেন অ্যাবিস। সম্রাজ্ঞির হাতে হীরাজহরত খচিত নক্সা করা দাবার একটি খুঁটি। জিনিসটা শক্ত করে বুকের কাছে চেপে ধরে তাকালেন অ্যাবিসের দিকে।
“আর বাকিগুলো?” বললেন তিনি। তবে তার কণ্ঠে এমন কিছু আছে যেটা অ্যাবিসকে উদ্বিগ্ন করে তুললো।
“ওগুলো এমন জায়গায় নিরাপদে লুকিয়ে রাখা হয়েছে যে তারা কোনোভাবেই এর ক্ষতি করতে পারবে না।”
“প্রিয় হেলেনে, সবগুলো অংশ আমাদেরকে একত্রিত করতে হবে এক্ষুণি! তুমি ভালো করেই জানো এই সার্ভিসটার ক্ষমতা সম্পর্কে। আমার মতো যোগ্য একজনের হাতে পড়লে এটা-”
“তুমি তো জানোই,” তার কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললেন অ্যাবিস, “অ্যাবির চারদেয়ালের মধ্য থেকে মন্তগ্লেইন সার্ভিস সরিয়ে ফেলার যে অনুরোধ বিগত চল্লিশ বছর ধরে তুমি আমাকে করে গেছে সেটা এড়িয়ে গেছি। এখন তার কারণটা তোমাকে বলবো। সার্ভিসটা কোথায় লুকিয়ে রাখা ছিলো আমি কিন্তু সেটা ভালো করেই জানতাম-” ক্যাথারিন বিস্মিত হয়ে কিছু একটা বলতে গেলে অ্যাবিস তার কাঁধে হাত রেখে তাকে বিরত রাখলেন। “ওটা লুকানো স্থান থেকে সরিয়ে ফেলার বিপদ সম্পর্কেও আমি ভালোভাবেই অবগত ছিলাম। এরকম একটা জিনিসের ব্যাপারে কেবলমাত্র একজন সেন্টকেই বিশ্বাস করা যায়। মাই ডিয়ার ফিগচেন, তুমি তো কোনো সেন্ট নও।”
“তুমি কি বলতে চাচ্ছো?” সম্রাজ্ঞি আর্তনাদ করে উঠলেন। “একটা খণ্ডবিখণ্ড জাতিকে একত্রিত করেছি আমি, অশিক্ষিত আর কুসংস্কারগ্রস্ত লোকজনকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেছি। প্লেগের মতো রোগ সমূলে উৎপাটন করেছি, নির্মাণ করেছি হাসপাতাল, স্কুল, রাশিয়ার অভ্যন্তরে নানান ধরণের সমস্যা দূর করে যুদ্ধের সম্ভাবনা শেষ করে দিয়েছি। কোণঠাসা করে ফেলেছি এ দেশের শত্রুদের। তুমি কি আমাকে অত্যাচারি শাসক মনে করো নাকি?”
“আমি শুধুমাত্র তোমার নিজের কল্যাণের কথা ভেবেছি,” শান্তকণ্ঠে বললেন অ্যাবিস। “এই জিনিসটার এমন ক্ষমতা আছে যে সবচাইতে ঠাণ্ডা মাথাকেও বিগড়ে দিতে পারে অনায়াসে। মনে রেখে মন্তগ্লেইন সার্ভিসটা আরেকটুর জন্যে ফ্রাঙ্কিশ সাম্রাজ্যকে খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলছিলো। শার্লেমেইনের মৃত্যুর পর তার ছেলে এটার জন্যে যুদ্ধ পর্যন্ত করেছিলো।”
“একটা আভ্যন্তরীণ বিবাদ, নাক সিটকিয়ে বললেন ক্যাথারিন। “আমি বুঝতে পারছি না কিভাবে এ দুটো জিনিসের মধ্যে সম্পর্ক থাকতে পারে।”
“মধ্য-ইউরোপের ক্যাথলিক চার্চই কেবল এটার অতিপ্রাকৃত ক্ষমতাকে দীর্ঘদিন ধরে গোপন রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু যখন শুনতে পেলাম ফ্রান্স বিল অব সিজার নামের একটি আইন পাস করেছে, যার ফলে ফ্রান্সে অবস্থিত চার্চগুলোর সমস্ত সম্পত্তি সরকারের অধীনে চলে যাবে, তখনই বুঝতে পারলাম আমার বাজে আশংকাটাই সত্যি হতে চলেছে। ফরাসি সরকার মন্তগ্লেইনের অভিমুখে রওনা দিয়েছে, এ খবরটা শোনা মাত্রই আমি আর দেরি করি নি। মন্তগ্লেইনে কেন আসবে ওরা? আমরা তো প্যারিস থেকে অনেক দূরে পাবর্ত্য অঞ্চলের একটি অ্যাবি। প্যারিসের কাছাকাছি আরো অনেক সম্পদশালী অ্যাবি আছে, সেগুলো লুট করাই তো বেশি সহজ ছিলো। না। তারা লুট করতে চায় সার্ভিসটা। অনেক ভেবেচিন্তে অবশেষে সার্ভিসটা সরিয়ে ফেলি অ্যাবি থেকে, ছড়িয়ে দেই সমগ্র ইউরোপে যাতে করে দীর্ঘদিনেও এটা একত্রিত করা সম্ভব না হয়—”
“ছড়িয়ে দিয়েছো!” চিৎকার করে উঠলেন সম্রাজ্ঞি। আসন থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, এখনও বুকের কাছে কালো রঙের রাণীর খুঁটিটা ধরা আছে। খাঁচায় বন্দী প্রাণীর মতো অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলেন তিনি। “তুমি এরকম একটা কাজ কিভাবে করতে পারলে? তোমার উচিত ছিলো আমার কাছে এসে এ ব্যাপারে সাহায্য চাওয়া!”
“সেটা আমি করতে পারতাম না!” বললেন অ্যাবিস। তার কণ্ঠে ভ্রমণের ক্লান্তি। “আমি জানতে পেরেছি অন্য কেউও এই সার্ভিসটার অবস্থান জানে। সম্ভবত বিদেশী কোনো শক্তি, ফরাসি অ্যাসেম্বলির সদস্যদেরকে বিল অব সিজার পাস করানোর জন্য ঘুষ দিয়েছে, মন্তগ্লেইনের দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ করেছে তারাই। এটা কি কাকতালীয় ব্যাপার বলে মনে হয় না যে, এই অপশক্তি বিখ্যাত বক্তা মিরাবু আর আঁতুয়ার বিশপকে ঘুষ দেবার চেষ্টা করেছিলো? একজন বিলটার লেখক, আর অন্যজন এটার পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা রেখেছে অ্যাসেম্বলিতে। এই এপ্রিলে মিরাবু যখন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলেন তখন বিশপ তার মৃত্যুর আগপর্যন্ত বিছানার পাশ থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও সরে নি। কোনো সন্দেহ নেই, বিশপ কোনো প্রকার চিঠিপত্র হস্তগত করতে মরিয়া ছিলো যা তাদের দু’জনের বিরুদ্ধে যেতো।”
“তুমি এসব কথা কিভাবে জানতে পারলে?” বিড়বিড় করে বললেন ক্যাথারিন। ঘুরে তাকালেন অ্যাবিসের দিকে।
“আমার কাছে তাদের চিঠি রয়েছে,” জবাব দিলেন অ্যাবিস। তাদের দু’জনের কেউই কোনো কথা বললো না বেশ কিছুটা সময় ধরে। অবশেষে নরম ডিমলাইটের আলোয় কথা বললেন অ্যাবিস। “তুমি জানতে চেয়েছিলে না, আমি কেন ফ্রান্স থেকে এতো দেরি করে এলাম, আশা করি তুমি এর উত্তর পেয়ে গেছো। কে আমাকে দিয়ে বাধ্য করেছে হাজার বছর ধরে লুকিয়ে রাখা গোপনস্থান থেকে মন্তগ্লেইন সার্ভিসটা সরিয়ে ফেলতে, সেটা আমি জানতে চেয়েছিলাম। কে সেই শত্রু যে আমাকে শিকারের মতো তাড়িয়ে বেড়িয়েছে, যতোক্ষণ না আমি চার্চের সাহায্যে মহাদেশের অন্যপ্রান্তে পালিয়ে গেছি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে?”